শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৪

দু’আ-র ক্ষমতা


দুআ এমন এক অবিশ্বাস্য শক্তি যা অনেক সময় আমরা একেবারেই বুঝে উঠতে পারি না; কারণ, আমরা যদি বুঝতেই পারতাম, তবে আমাদের দুআ কবুল হওয়ার জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করতাম। কখনও কখনও আমাদের দুআ সাথে সাথেই কবুল হয়, আর কখনও কখনও আমাদের প্রত্যাশার চাইতেও বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। যাই হোক, যদি সঠিকভাবে দুআ করা হয় তবে তা বদলে দিতে পারে আমাদের জীবন এবং নিয়ে আসতে পারে অভাবনীয় ফলাফল।

দু'আ
দুআ কবুল হওয়ার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই দুআ-র পেছনের ক্রিয়াকৌশল পুরোপুরি বুঝতে হবে। প্রথমত, আমাদের অবশ্যই সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকতে হবে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের দুআ কবুল করবেনই। আমাদের মনে এ ব্যাপারে সামান্যতম দ্বিধাও যেন না থাকে যে আল্লাহ আমাদের সকল দুআ শুনছেন এবং আমাদের সকল আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম। আমাদেরকে অবশ্যই এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে যে, আমরা যেন আমাদের দুআ-র ব্যাপারে আশাহত না হই এবং দুআ কবুল হওয়ায় বিলম্ব দেখে অধৈর্য না হয়ে পড়ি। আমাদের প্রতিনিয়ত নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, আমাদের দুআ সমূহ কবুল হওয়ার একমাত্র চাবিকাঠি হল দুআ-য় অটল থাকা। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, আমাদের যেন এমন কোন পাপ না থাকে যার জন্য আমরা আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তওবা করিনি, কারণ এটা আমাদের দুআ কবুল হওয়ার পথে প্রথম বাধা হতে পারে; বিশেষ করে যদি সে পাপ অবৈধ উপায়ে উপার্জনের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে।

একবার যদি এটা পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায় এবং সেই অনুসারে কাজ করা যায়, তবে এটা নিশ্চিত যে আপনি যা চান আল্লাহ আপনাকে তা-ই দান করবেন কিংবা তার চেয়েও উত্তম কিছু দিবেন; আর হতে পারে আপনাকে আল্লাহ তা এমন উপায়ে দিবেন যা আপনি কখনও কল্পনাও করেননি।

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেনঃ

...আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন।...
[সূরা আত-তালাক্বঃ ০২-০৩]

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আরও বলেনঃ

আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে, বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে।...
[সূরাআল-বাক্বারাঃ ১৮৬]

এখন আমি একটি গল্প শোনাবো যা প্রমাণ করে দুআ কতটা শক্তিশালী হতে পারে; আর আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) কত বিস্ময়করভাবে আমাদের দুআ-র জবাব দিতে পারেন। এই ঘটনাটিকে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে না ধরে রূপক হিসেবে বিবেচনা করাই উত্তমঃ

ডাঃ সাঈদ, একজন সুপরিচিত ডাক্তার। একবার তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ মেডিক্যাল কনফারেন্সের জন্য অন্য একটি শহরে যাচ্ছিলেন, যেখানে তাকে চিকিৎসাক্ষেত্রে তার সাম্প্রতিক গবেষণার জন্য পুরস্কৃত করা হবে। এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে তিনি বার বার উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন এবং সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য তার যেন আর তর সইছিলো না। তিনি তার গবেষণা কাজে দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছেন, যার ফলে নিজেকে উক্ত পুরস্কারের যোগ্য দাবিদার বলে মনে করেন। যাই হোক, এক ঘন্টা পর প্লেন যখন যাত্রা করল, পাইলট ঘোষণা করলেন প্লেনে সমস্যা আছে এবং তারা নিকটবর্তী এয়ারপোর্টে জরুরি অবতরণ করবেন।

সঠিক সময়ে সম্মেলনে যোগ না দিতে পারার আশঙ্কায় তিনি ভীত হয়ে পড়লেন এবং প্লেনটি অবতরণ করার সাথে সাথেই তথ্য সংগ্রহের ডেস্কের কাছে ছুটে গিয়ে রিসেপশনে থাকা মহিলাটিকে তার অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে যোগদানের কথা বললেন যাতে তারা তার গন্তব্যে পৌঁছার জন্য বিকল্প কোন ব্যবস্থা করতে পারে। মহিলাটি তাকে বলল, সাহায্য করার মতো বিকল্প কোন উপায় তার জানা নেই, কারণ পরবর্তী ষোল ঘণ্টার মধ্যে তার গন্তব্যের দিকে আর কোন ফ্লাইট যাবে না; তবে তিনি ইচ্ছে করলে গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন যা এখান থেকে মাত্র তিন ঘণ্টার পথ। আর কোন উপায় না দেখে ডাক্তার সাহেব গাড়ি ভাড়া করার সিদ্ধান্ত নিলেন যদিও দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চড়তে তিনি পছন্দ করেন না।

ডাক্তার সাহেব গাড়ি ভাড়া করে তার যাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ আবহাওয়া বদলে গেল এবং প্রচণ্ড ঝড় শুরু হল। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে তিনি সামনের কোন কিছুই দেখছিলেন না, যার ফলে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য একটি বাঁক নেয়ার কথা থাকলেও তিনি ভুল করলেন। প্রায় দুঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর তিনি বুঝতে পারলেন তিনি হারিয়ে গেছেন। ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত অবস্থায়, প্রচণ্ড বৃষ্টিতে জনমানবহীন রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি জনবসতির খোঁজ করছিলেন। কিছু সময় পর তিনি একটি ছোট কুঁড়ে ঘর দেখতে পেলেন। মরিয়া হয়ে তিনি গাড়ি থেকে নামলেন এবং ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন।

ছোটখাট একজন বয়স্কা মহিলা দরজা খুলে দিলেন। ডাক্তার সাহেব মহিলাকে তার অবস্থা সম্পর্কে জানালেন এবং তার টেলিফোনটি ব্যবহার করার অনুমতি চাইলেন। মহিলাটি তাকে বলল তার ঘরে টেলিফোন  কিংবা বিদ্যুৎ কোনটিই নেই; তবে যেহেতু তিনি তার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন এবং খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লাগবে তাই তিনি ইচ্ছে করলে ভিতরে এসে হালকা খাবার ও সামান্য উষ্ণ পানীয় গ্রহণ করতে পারেন। ক্ষুধার্ত, ভেজা জামা-কাপড় এবং ক্লান্ত শরীর নিয়ে ডাক্তার সাহেব তার এই সদয় অনুগ্রহ গ্রহণ করলেন এবং ভিতরে প্রবেশ করলেন। মহিলাটি তার জন্য টেবিলে সামান্য খাবার এবং চা দিয়ে তার কাছে সালাত আদায় করার অনুমতি চাইলেন।

টেবিলে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে মোমবাতির মৃদু আলোতে ডাক্তার সাহেব দেখলেন মহিলাটি সালাত আদায় করছে, আর তার সামনেই দেখা যাচ্ছে একটি ছোট শিশুর দোলনাপ্রতিবার সালাত শেষে তিনি পুনরায় শুরু করছেন, আর মনে হচ্ছে সিজদায় গিয়ে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে দুআ করছেন। মাঝে মাঝে তিনি মৃদুভাবে শিশুর বিছানাটিও দুলিয়ে দিচ্ছেন।

ডাক্তার সাহেব মনে করলেন মহিলাটির সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। তাই সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তিনি মহিলাটির সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজলেন এবং বললেন তিনি আশা করেন আল্লাহ তার (মহিলাটির) দুআ কবুল করবেন। তিনি বললেন সালাতের সময় মহিলাটিকে তিনি অনেক দুআ করতে দেখেছেন এবং তিনি মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলেন তার কোন কিছু প্রয়োজন কিনা, হতে পারে তিনি তাকে তা পেতে সাহায্য করতে পারবেন। মৃদু হেসে মহিলাটি বললেন শুধুমাত্র একটি দুআ ছাড়া আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) তার সবগুলো দুআই কবুল করেছেন। বৃদ্ধাটি বললেন তিনি ঠিক বুঝতে পারেননি আল্লাহ কেন তখনও তার সেই দুআটি কবুল করেননি এবং এও বললেন হয়তো এটা তার দুর্বল ঈমানের কারণে

ডাক্তার সাহেব মহিলাটিকে বললেন, যদি তিনি কিছু মনে না করেন তবে তাকে (ডাক্তার সাহেবকে) কী কীসের জন্য তিনি দুআ করছিলেন তা বলা যাবে? মহিলাটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন, তিনি বললেন, বিছানায় থাকা শিশুটি তার নাতি এবং তার বাবা-মা দুজনই সম্প্রতি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। তিনি বললেন শিশুটির এক বিশেষ ধরনের ক্যান্সার হয়েছে আর এ পর্যন্ত তিনি যত ডাক্তার দেখিয়েছেন কেউই তার চিকিৎসা করতে পারেনি। তিনি আরও বললেন, ডাক্তাররা তাকে বলেছেন একজন ডাক্তার আছেন যিনি এই রোগের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ, সেই ডাক্তার অনেক দূরে থাকায় তার পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়; তাই তিনি দিনরাত আল্লাহর কাছে দুআ করছেন যেন আল্লাহ তাকে ডাক্তার সাঈদ (যিনি তার নাতির চিকিৎসা করতে পারবেন) এর সাথে দেখা করার উপায় করে দেন।

তার কথা শুনে ডাক্তার সাহেবের চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে গেল এবং তিনি বললেনঃ সুবহান আল্লাহ, প্লেনে সমস্যা, ঝড়, আমার রাস্তা হারিয়ে ফেলা; আল্লাহ এসব কিছু ঘটিয়েছেন শুধুমাত্র আপনার দুআ কবুল হওয়ার মাধ্যমে ডাক্তার সাঈদের সাথে দেখা হওয়ার জন্য নয়, বরং ডাক্তার সাঈদকে সরাসরি আপনার বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। আমিই ডাক্তার সাঈদ।

অশ্রু সজল চোখে বৃদ্ধা হাত তুলে দুআ করতে লাগলেনঃ হে আল্লাহ! তুমি কত মহান ও দয়াময়!




মূল লেখকঅনুবাদ সহযোগীতাউৎস
যাইনীব শীবানিইমরান হেলালwww.SuhaibWebb.com

0 on: " দু’আ-র ক্ষমতা"