শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩

অনিয়ন্ত্রিত রাগ ও ইসলামিক সমাধান (পর্ব ২)

পর্ব ১ » এখানে


দ্বিতীয় পর্বে আমরা আল-কুর’আন ও নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীস থেকে দেখবো রাগান্বিত অবস্থায় কেমন ব্যবহার করা উচিত।


রাগ‘রাগ’ ধ্বংস করে দিতে পারে জীবন ও সম্পর্ক। আর এ কারণেই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটাকে বলেছেন, আদম সন্তানের অন্তরে একটি উত্তপ্ত কয়লা। রাগকে পুরোপুরি বর্জন করার মত কোন পরীক্ষালব্ধ উপায় এখনও আবিষ্কৃত হয়নি, কারণ এটি একটি সহজাত মানবীয় অনুভূতি। অবশ্য ইসলামে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেগুলো থেকে আমরা দেখতে পাই কীভাবে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে গ্রহণযোগ্য কাজে পরিণত করা যায়। ইসলামিক এই নির্দেশনাগুলো পালনের কিছু বিশেষ আধ্যাত্মিক উপকারিতাও আছে। এটা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এবং যে ব্যক্তি এমনটি করে সে (আধ্যাত্মিকভাবে) পুরস্কৃত হয়।  নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ


যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধকে কার্যে পরিণত করার ক্ষমতা রেখেও তা সংবরণ করে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন সমগ্র সৃষ্টি সামনে ডেকে আনবেন এবং জান্নাতের যে কোন হূর নিজের ইচ্ছামত বেছে নেয়ার অধিকার দান করবেন।
[সুনানু ইবনে মাজাহঃ ৪১৮৬]

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেন,


আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বান্দার ক্রোধ সংবরণে যে মহান প্রতিদান রয়েছে তা অন্য কিছু সংবরণে নেই।
[সুনানু ইবনে মাজাহঃ ৪১৮৯]

এক ব্যক্তি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট বললো,


আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেনঃ তুমি রাগ করো না। লোকটা কয়েকবার তা বললেন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যেক বারই বললেনঃ রাগ করো না।
[সহিহ বুখারী, খণ্ড ৮, অধ্যায় ৭৩, হাদিসঃ ১৩৭]


এছাড়াও নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবন থেকে এমন অসংখ্য ঘটনা আমরা দেখতে পাই যেগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি, যখন রাগ আমাদের গ্রাস করতে চায় কিংবা আমরা রাগে বিস্ফোরিত হওয়ার হুমকিতে থাকি তখন আমাদের কী করা উচিত। তিনি বলেন,

যদি তোমাদের কেউ দাঁড়ানো অবস্থায় রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তবে তার উচিত বসে পড়া। যদি তার রাগ কমে যায়, তবে ভালো; নয়তো তার উচিত শুয়ে পড়া।
[আত-তিরমিযি]


নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের উপদেশ হিসেবে আরও বলেছেন রাগান্বিত অবস্থায় উযূ করতে, যা রাগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে; শয়তানকে তৈরি করা হয়েছে আগুন থেকে,  আর একমাত্র পানির মাধ্যমেই আগুন নেভানো সম্ভব। তাই তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তার উচিত উযূ করা।
[আবু দাউদ]


এছাড়া নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শয়তানের প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য একজন বিশ্বাসীকে অন্যান্য পদ্ধতি প্রয়োগের কথাও বলেছেন। একবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক রাগান্বিত ব্যক্তিকে উপদেশ দিলেন, যাতে সে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। তিনি তাঁর সেই সাহাবীকে বললেন,

আমি এমন একটি কালেমা জানি যা পাঠ করলে তা (ক্রোধ) তার থেকে চলে যায় । (আর তা হল) ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ্‌ শায়ত্বানির রাজীম’ অর্থাৎ আমি বিতাড়িত শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।
[সহীহ মুসলিম, বই ৩২, হাদিসঃ ৬৩১৭]

ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের আরও উপদেশ দিয়েছেন,


যদি তোমাদের কেউ রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তবে তাকে নিরব থাকতে দাও।


যদি কোন ব্যক্তি শান্ত বা নিরব হওয়ার চেষ্টা করে, তবে এটা অবশ্যই তাকে মারামারি কিংবা অশ্লীল ও কটু কথা বলায় বাঁধা প্রদান করবে। আরেকটি হাদীসে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাগ প্রশমনে কিছু ধারাবাহিক কাজের কথা বলেছেন। তিনি বলেন,

যদি তোমাদের মধ্যে কেউ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তবে তাকে বসতে দাও, তাহলে তার রাগ কমে যাবে; যদি এতেও তার রাগ না কমে, তাবে তাকে শুয়ে পড়তে দাও।
[ইমাম আহমাদ]


অতএব আমরা দেখতে পাই যে, ইসলাম একজন মানুষকে তার সহজাত অনুভূতি রাগ নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করার সুযোগ করে দেয়। প্রথমেই একজন মানুষের উচিত তার অবস্থার পরিবর্তন করা। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি দাঁড়িয়ে থাকে তার উচিত বসে পড়া; সে যদি আগে থেকেই বসা অবস্থায় থাকে তার উচিত শুয়ে পড়া। একজন রাগান্বিত মানুষ উযূ করে দুই বা ততোধিক রাকা’আত সালাত আদায় করতে পারে। অথবা সে আল্লাহর কাছে শয়তানের কুমন্ত্রণার ফলে রাগের যে খারাপ প্রভাব তা থেকে মুক্তি চাইতে পারে এবং মনোযোগী হতে পারে ধৈর্যশীল, দয়ালু ও ক্ষমাশীলদের জন্য আল্লাহর ঘোষিত পুরষ্কারসমূহের দিকে।

ন্যায়পরায়ণ মানুষের সংজ্ঞায় কুর’আনে বলা হয়েছে,


যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালবাসেন।
[আল-ইমরানঃ ১৩৪]


আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও প্রচুর আত্মসংযম ও ধৈর্যশীলতার পরিচয় দেখিয়েছেন যখন তাঁকে অপমান, অপদস্ত ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল। তাই তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আ’ইশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেছেন,

তাঁর চরিত্র (নবীজির) ছিল কুর’আনেরই প্রতিফলন।
[সহীহ মুসলিম]


জীবনের এক কঠিনতম সময়ে আমাদের প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তায়েফ শহরে গিয়েছিলেন এবং আশা করেছিলেন তায়েফবাসী তাঁর কথা শুনবে এবং তাঁকে সহযোগীতা করবে। কিন্তু সহযোগীতার পরিবর্তে তিনি পেলেন নারী ও শিশুদের কাছ থেকে অপমান ও পুরো শহর জুড়ে ধাওয়া। রক্ত তাঁর শরীর থেকে গড়িয়ে পায়ে গিয়ে জমাট বাঁধলো, আর অন্তর পরিপূর্ণ হল দুঃখে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন। জবাবে আল্লাহ তাঁর নিকট একজন ফেরেশতাকে পাঠালেন। ফেরেশতা তায়েফের দুপাশের পাহাড় এক করে দিয়ে তায়েফবাসীকে হত্যা করার অনুমতি চাইলো। তায়েফবাসী কর্তৃক যে ব্যথা-বেদনা ও দুঃখ-কষ্ট নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেয়েছিলেন, তার কারণে রেগে যাওয়া তাঁর জন্য পুরোপুরি সঙ্গত ছিল। কিন্তু আমাদের দয়ার নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উত্তর ছিল,

(না, তা হতে পারে না) বরং আমি আশা করি মহান আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন সন্তান জন্ম দেবেন যে, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে আর তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না।
[সহিহ বুখারী, খণ্ড ৪, অধ্যায় ৫৪, হাদিসঃ ৪৫৪]

অতএব, উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে ইসলামিক রাগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনাকে আমরা নিন্মোক্ত উপায়ে সাজাতে পারিঃ

  শয়তানের কুন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা।

  উযূ করা, কারণ পানি আগুন নিভিয়ে দেয়।


  অবস্থার পরিবর্তন করা অর্থাৎ কেউ যদি দাঁড়িয়ে থাকে তার উচিত বসে পড়া; সে যদি আগে থেকেই বসা অবস্থায় থাকে তার উচিত শুয়ে পড়া। আর একজন শুয়ে থাকা মানুষ কখনোই মারামারি কিংবা সম্পদ বিনষ্ট করার মত কাজ করতে পারে না।

  নিজেকে সে অবস্থা থেকে সরিয়ে নেয়া, যা অনেকটা আধুনিককালের ‘Time Out’ এর মত।


  শান্ত হওয়ার চেষ্টা করা। কারণ, রাগের মাথায় বলে ফেলা কথা অনেকটা বন্দুকের নল থেকে বেরিয়ে যাওয়া গুলির মত, যা ফিরিয়ে নেয়া অসম্ভব।


ইনশা আল্লাহ আমরা সকলেই চেষ্টা করব, উপর্যুক্ত পদ্ধতিগুলো শুধুমাত্র পড়ার মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার। জাযাক আল্লাহ খাইরান।

পাদটীকাঃ

[১] আত-তিরমিযি

মূল লেখকঃ আ’ইশা স্ট্যাসি

4 on: "অনিয়ন্ত্রিত রাগ ও ইসলামিক সমাধান (পর্ব ২)"
  1. সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ এর জন্য যে আল্লাহর অশেষ রহমতে ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ সিরিজের প্রথম বইয়ের অনুবাদ “খোরাসান থেকে কালো পতাকা” প্রকাশিত হয়েছে। হলুদ মিডিয়া যা জানতে দিবে না তা জানতে পড়ুন এই বইগুলো।

    বইটি আপনারা এখান থেকে ডাউনলোড করতে পারবেন। এছাড়া অনলাইনেও পড়ার ব্যাবস্থা ও আলাদা প্রবন্ধ হিসেবে পড়ার ব্যাবস্থাও আছে।

    http://blackflagseriesinbangla.wordpress.com/

    https://www.facebook.com/blackflagseriesinbangla

    উত্তরমুছুন