বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৩

অনিয়ন্ত্রিত রাগ ও ইসলামিক সমাধান (পর্বঃ ১)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম


‘একদিন ফেইসবুকে ইসলামকে নিয়ে লেখা এক নাস্তিকের চরম মিথ্যাচারমূলক পোস্ট পড়ে নাফিসের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। রাগে-ক্ষোবে তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। ফলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মন্তব্যের ঘরে সে ঐ নাস্তিককে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে লাগলো। আর এটা কাজ করলো অনেকটা আগুনে ঘি ঢালার মতই। নাফিসের গালিগালাজ দেখে ঐ নাস্তিক এবার সমগ্র মুসলিম জাতি ও ইসলামকে নিয়ে মিথ্যাচার শুরু করলো...’


‘শীত এসে গেছে। রিফাতের বন্ধুরা ঠিক করেছে সবাই মিলে কক্সবাজার যাবে। রিফাতও সবার সাথে যেতে চায়। তাই সে তার মাকে বলল তার বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে দিতে। কিন্তু তার বাবা বলল কিছুদিন পরই তারা স্বপরিবারে সেন্টমার্টিন যাবে। আর যখনই রিফাত শুনলো যে তার বাবা টাকা দিবে না, সে খুব রেগে গেল এবং তার মায়ের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করল...’

রাগ
যদিও রাগ একটি স্বাভাবিক অনুভূতি, এটি মানুষের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যারা একে লাগামছাড়া করে ফেলে। এমনকি এটি তাদের আশে পাশের মানুষের উপরও বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। রাগ ধ্বংস করে দিতে পারে সম্পর্ক, স্বাস্থ্য, সম্পদ ও জীবিকা। অনিয়ন্ত্রিত রাগ শয়তানের একটি হাতিয়ার এবং এটি আমাদের অসংখ্য পাপ ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এ কারণে রাগ সম্পর্কে ইসলামে অনেক কিছুই বলা হয়েছে।


কারণ অনেক সময় রাগ ‘সংঘাত কিংবা ঝোঁকের’ সাথে সম্পর্কিত। কখনও কখনও এটা পৃথক করা কঠিন হয়ে পড়ে যে, কোন কাজ আত্মরক্ষার জন্য (অথবা সম্পদ বা পরিবার রক্ষার জন্য) করা হয়েছে নাকি অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধের কারণে করা হয়েছে। রাগ করা দোষের কিছু নয়, কিন্তু এটি বর্জনীয় যখন একজন মানুষ একে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয়, যা তাকে ধ্বংসাত্মক কাজের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি কখনও কখনও এটি মানুষকে খুন ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার দিকেও ধাবিত করতে পারে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামাতা, সাহাবী আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর একটি ঘটনা আমাদেরকে পার্থক্যটি হাতে কলমে দেখিয়ে দেয়।


এক যুদ্ধে আলী ইবনে আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) অমুসলিম বাহিনীর সেনাপ্রধানের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন। সম্মুখ যুদ্ধের সময় আলী (রাঃ) তাকে ধরাশায়ী করলেন এবং যখন তাকে হত্যা করতে উদ্ধত হলেন, সে আলী (রাঃ) এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। সাথে সাথে আলী (রাঃ) লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলেন। লোকটি বলল, “তুমি আমাকে হত্যা করতে পারতে, কিন্তু তা করলে না কেন?” উত্তরে আলী (রাঃ) বললেন, “তোমার সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। তোমার সাথে আমি যুদ্ধ করেছি শুধুমাত্র তোমার অবিশ্বাস ও আল্লাহর প্রতি বিদ্রোহের কারণে। আমার মুখে থুথু নিক্ষেপের পর আমি যদি তোমাকে হত্যা করতাম, তবে তা হয়ে পড়তো আমার ব্যক্তিগত ক্ষোব ও প্রতিশোধস্পৃহার বহিঃপ্রকাশ, যা আমি কখনোই চাই না।”


নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার সাহাবীদের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মধ্যে কাকে তোমরা অধিক শক্তিশালী মনে কর?” তাঁরা উত্তর দিলেন, “যে ব্যক্তি কুস্তিতে অন্যকে হারিয়ে দিতে পারে।” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “সে প্রকৃত বীর নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়। বরং সে-ই প্রকৃত বীর, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।[১]

কোন ব্যক্তি যদি সবসময় অনিশ্চয়তায় ভোগে যে কোন পরিস্থিতিতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে, তবে তাকে শুধু নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অথবা আমাদের ন্যায়পরায়ণ পূর্বসূরীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে হবে প্রতিক্রিয়া দেখানোর সর্বোত্তম উপায়টি খোঁজার জন্য। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিশেষ খ্যাতি ছিল এজন্য যে, ভীষণ খারাপ পরিস্থিতিতেও তিনি তাঁর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন এবং করতেন। একদিন এক বেদুঈন এসে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আক্রমণ করে বসল। সে রূঢ়ভাবে নবীজির জামার কিনারা চেপে ধরলো, আর এতে নবীজির ঘাড়ে দাগ পড়ে গেল যা সাহাবাদের দেখে ফেলার সম্ভাবনা ছিল। বেদুঈন লোকটি তাঁর কাছে কিছু সম্পদ দাবি করল। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাসিমুখে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন (যেখানে রেগে যাওয়া তাঁর জন্য পুরোপুরি ন্যায়সঙ্গত ছিল)। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেদুঈনকে দাবি অনুযায়ী কিছু সম্পদ দিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন।[২]


আমরা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে অনুসরণ করতে পারি রাগ দেখানোর ক্ষেত্রেও, যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য, যখন তাঁর আদেশ অমান্য করা হয়। এটা এক প্রকার নিয়ন্ত্রিত রাগ, যা প্রশংসনীয়। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও রাগান্বিত হয়েছিলেন, যখন তাঁকে বলা হয়েছিল কোন এক ইমাম সালাত দীর্ঘ করায় সাধারণ মানুষ সালাতবিমুখ হয়ে পড়ছিল, যখন তিনি দেখেছিলেন প্রাণীর ছবিযুক্ত একটি পর্দা এবং যখন তাঁকে এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল যা তিনি অপছন্দ করতেন। আর তাঁর এই রাগ ছিল পুরোপুরি আল্লাহর জন্য। তিনি কখনও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েননি, ক্ষেপে জাননি কিংবা তাঁর উপস্থিতি মানুষের মনে কখনও ভীতির সঞ্চার করেনি।


যখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কারও ভুল কাজ কিংবা কথার কারণে রেগে যেতেন, তিনি কখনোই তা পেশীশক্তির মাধ্যমে ব্যক্ত করতেন না, বরঞ্চ কোমল ভাষা ব্যবহার করতেন। এমনকি যারা তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি জানতো না, তারা বুঝতেই পারতো না যে তিনি রাগান্বিত। তবে সাহাবারা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর দিকে লক্ষ্য করেই বুঝতে পারতেন তিনি রাগান্বিত, তাঁর চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করত এবং কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতো। কিন্তু বাহ্যিকভাবে ক্রোধ প্রকাশ করার পরিবর্তে তিনি শান্ত থাকতেন এবং রাগের প্রাথমিক পর্যায়েই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেন।

রাগ নিয়ন্ত্রণ পরহেযগারীতার একটি প্রতীক। আর পরহেযগার ব্যক্তির জন্য আল্লাহ জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন।



তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও যমীন, যা তৈরি করা হয়েছে পরহেযগারদের জন্য। যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরই ভালোবাসেন।

[সূরা আল-‘ইমরানঃ ১৩৩-১৩৪]


অতএব তোমাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ মাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তা উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী তাদের জন্য যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও তাদের পালনকর্তার উপর ভরসা করে। যারা বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে এবং ক্রোধান্বিত হয়েও ক্ষমা করে।

[সূরা আশ-শুরাঃ ৩৬-৩৭]


রাগ খুব স্বাভাবিক একটি মানবীয় অনুভূতি। এটি খুবই শক্তিশালী এবং তরিৎবেগে মৃদু উত্তেজনা থেকে প্রচণ্ড ক্রোধ ও উন্মত্ততায় রূপ নিতে পারে। শেষ পর্যন্ত ধ্বংসাত্মকও হয়ে পড়তে পারে। এটি মানুষের মনে প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে তোলে এবং রাগের লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে প্ররোচিত করে। কারণ, এটাই স্বাভাবিক যে, রাগকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। তবে একে বোঝা এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।


প্ররোচিত হয়ে কিংবা অন্য কোন কারণে যখন একজন মানুষ রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তখন তার স্বাধীনতা থাকে কুর’আন ও সুন্নাহর আলোকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তা নিয়ন্ত্রণ করার কিংবা আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন আচরণ করার যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে কিন্তু শয়তানকে করে আনন্দিত।


যখন থেকেই ইসলামের উপর কালিমালেপন শুরু হয়েছে, তখনই বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মুসলিম তাদের রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছে। আমাদের ধর্ম ও নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নামে কটূক্তি ও অপবাদ আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক, কিন্তু বিশ্বাসী হিসেবে আমাদের উচিত আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা যাতে তা আমাদের কাজকে প্রভাবান্বিত না করে। আমদেরকে কাজ করতে হবে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও বিচক্ষণতার আলোকে। যারা মিথ্যাচার ও ধোঁকার মাধ্যমে ইসলামকে ছোট করতে চায় তাদেরকে আমরা পুরোপুরি দমিয়ে রাখতে পারব না, কিন্তু আমরা তো পারব নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে, সাধারন মানুষকে শেখাতে এবং অন্যান্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যেগুলো ইসলামে বৈধ।

পাদটীকাঃ

[১] সহীহ বুখারীঃ ৫৬৮৪

[২] সহীহ বুখারী ও মুসলিম

মূল লেখকঃ আ’ইশা স্ট্যাসি

পর্ব ২ » এখানে

4 on: "অনিয়ন্ত্রিত রাগ ও ইসলামিক সমাধান (পর্বঃ ১)"
  1. মা-শা-আল্লাহ, লা- কুউওয়াতা ইল্লা- বিল্লা-হ

    উত্তরমুছুন
  2. দ্বীনী ভাই১২/২৩/২০১৩

    জাজাকাল্লাহ খাইর , দরকারী।

    উত্তরমুছুন
  3. বারাক আল্লাহ ফিকুম। খুশি হব যদি বন্ধুদেরও জানিয়ে দেন এ ব্যাপারে।

    উত্তরমুছুন