অন্তরের প্রশান্তির বিষয়টি একটি সর্বজনীন চাহিদা। পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যার অন্তরের প্রশান্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা নেই।
এটি এমন কোন আকাঙ্ক্ষা নয় যা আমাদের যুগেই নতুন। বরং এটি এমন এক জিনিস, যা মানুষ খুঁজে আসছে যুগ যুগ ধরে; বর্ণ, বিশ্বাস, ধর্ম, গোত্র, জাতীয়তা, বয়স, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলেই।
অন্তরের প্রশান্তি অর্জনের লক্ষ্যে মানুষ অবলম্বন করে আসছে বিভিন্ন পথ। কেউ ধনসম্পদ সঞ্চয়ের মাধ্যমে, কেউবা আবার নেশা করে; কেউ গানবাজনায়, কেউবা ধ্যানে; কেউ তাদের স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে, কেউ নিজেদের ক্যারিয়ারে, কেউ সন্তান-সন্ততির সাফল্যে। আর এই তালিকা ক্রমবর্ধমান...
তারপরও অন্তরের প্রশান্তির খোঁজ এখনও চলমান। বর্তমানে আমাদেরকে এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয় যে, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং আধুনিকায়ন আমাদের শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিবে, যার মাধ্যমে আমরা অন্তরের প্রশান্তি অর্জন করতে পারব।
কিন্তু আমরা যদি প্রযুক্তি এবং শিল্পক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত দেশ আমেরিকার দিকে দৃষ্টিপাত করি, তবে দেখব যে, আমাদের যা বিশ্বাস করানো হয় তা আসলে সঠিক নয়। পরিসংখ্যান আমাদের বলে প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান হতাশায় ভোগে। আর হতাশা বলতে কি শুধুই অন্তরের প্রশান্তির অভাবকে বোঝানো হয়? ২০০০ সালে আমেরিকায় আত্মহত্যার কারণে মৃত্যুহার ছিল AIDS এর কারণে মৃত্যুহারের দ্বিগুণ। যাই হোক, মিডিয়া সবসময় এসব তথ্য আড়াল করে রাখতে চায়, আমরা শুধু তাদের কথাই শুনি যারা AIDS এর কারণে মারা যায়, কিন্তু তাদের কথা আমাদের শোনানো হয় না যারা মারা যায় আত্মহত্যায়। এমনকি খুনের চাইতেও আমেরিকায় আত্মহত্যার পরিমাণ বেশি।
অর্থাৎ বাস্তবতা হচ্ছে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কিংবা আধুনিকায়ন অন্তরের প্রশান্তি এনে দিতে পারেনি। বরঞ্চ আধুনিকায়নের ফলে এসব মানবীয় স্বাচ্ছন্দ্য আন্তরিক প্রশান্তি লাভের পথ থেকে আমাদের আরও দূরে সরিয়ে নিচ্ছে, যা আমাদের পূর্ববর্তীগণ লাভ করে এসেছেন।
অন্তরের প্রশান্তি লাভে বাঁধা
অন্তরের প্রশান্তি আমাদের জীবনের অধিকাংশ সময়ই অধরা থেকে যায়, আমরা কখনোই এর উপর আমাদের কর্তৃত্ব ফলাতে পারি না।
আমরা ব্যক্তিগত সুখকে অন্তরের প্রশান্তির সাথে গুলিয়ে ফেলি। বিভিন্ন রকম উপাদানের মাধ্যমে আমরা সুখ অর্জন করতে পারি, হতে পারে ধন সম্পদ, যৌন সম্পর্ক বা অন্য কিছু। কিন্তু এদের কোনটিই স্থায়ী নয়, এগুলো আসে আবার চলে যায়। তবে বিভিন্ন সময় আমরা যে সুখ ও আনন্দ পেয়ে থাকি সেগুলো কিন্তু অন্তরের প্রশান্তি নয়। প্রকৃত অন্তরের প্রশান্তি হচ্ছে এমন একটা অনুভুতি যা জীবনের সকল দুঃখ-কষ্টের সময়ও আমাদের স্থিরতা এবং আত্মতৃপ্তি দান করে।
আমাদের বুঝতে হবে শান্তি এমন কিছু নয় যা দুনিয়াতে আমাদের চারপাশে থাকবে, কারণ আমরা যখন শান্তির সংজ্ঞা দিতে যাই, অভিধান অনুসারে বলা হয় এটি যুদ্ধ এবং অসামরিক শত্রুতামুক্ত একটি অবস্থা। কিন্তু কোথায় এমন শান্তি? পৃথিবীতে সবসময় যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা লেগেই রয়েছে।
আমরা যদি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের শান্তির দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে শান্তি বলতে বোঝায় জনবিশৃঙ্খলা মুক্ত, নিরাপদ জীবন-যাপন; কিন্তু পৃথিবীর কোথায় এমনটি সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যাবে? আমরা যদি সামাজিক, পারিবারিক বা কর্মক্ষেত্রের শান্তির কথা বিবেচনা করি, তবে শান্তি বলতে বোঝায় তর্ক-বিতর্ক ও মত বিরোধ মুক্ত থাকা; কিন্তু পৃথিবীতে কী এমন কোন সামাজিক পরিবেশ আছে যেখানে কোনদিন মত বিরোধ বা তর্ক-বিতর্ক ঘটেনি? স্থানের বিবেচনায় হয়তো এমন জায়গা থাকতে পারে, যা নীরব, নিস্তব্ধ ও প্রশান্ত; উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে একটি দ্বীপের কথা, কিন্তু এই বাহ্যিক সুখ ক্ষণস্থায়ী। আজ কিংবা কাল আসতে পারে প্রবল ঝড়।
আল্লাহ বলেন,
“অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি ক্লেশের মধ্যে।”
[আল-বালাদঃ ০৪]
এটাই আমাদের জীবনের প্রকৃতি। আমরা সবসময় স্বাচ্ছন্দ্য-সংগ্রাম, উত্থান-পতন ও পরীক্ষার মধ্য দিয়েই জীবন অতিবাহিত করি। আল্লাহ বলেন,
“এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।”
[আল-বাক্বারাহঃ ১৫৫]
আর কষ্ট ও সংগ্রামের এসব পরিস্থিতিকে সামাল দিতে ধৈর্যই আমাদের চাবিকাঠি। কিন্তু আমরা যদি অন্তরের প্রশান্তির কথায় ফিরে যাই, যা আমরা খুঁজছি, তবে ধৈর্য নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না যদি আমাদের অন্তরে প্রশান্তি না থাকে।
আমরা কষ্ট ও সংগ্রামের পৃথিবীতে বাস করছি। কিন্তু এর মাঝেও অন্তরের প্রশান্তি অর্জন করা সম্ভব, এমনকি পরিবেশ এবং পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়েও। অবশ্যই এর মাঝে কিছু বাঁধা-বিপত্তি আছে। তাই প্রথমেই আমাদের সেই সকল বাঁধা-বিপত্তিকে চিহ্নিত করতে হবে, যেগুলো আমাদের অন্তরের প্রশান্তি অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং কিছু কৌশলের উন্নতি করতে হবে সেই বাঁধা-বিপত্তিগুলো দূর করার জন্য। শুধুমাত্র এটা চিন্তা করলেই বাঁধাগুলো দূর হয়ে যাবে না যে, আমাকে সেগুলো দূর করতে হবে। বরং আমাদের কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে এর জন্য।
তাহলে আমাদের কী করা উচিত, যাতে এই বাঁধাগুলো দূর করে অন্তরের প্রশান্তি অর্জন করতে পারি?
প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, আমাদেরকে সেই বাঁধাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আর এ জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে। কারণ, আমরা যদি সেগুলো চিহ্নিত করতে না পারি, তবে দূরও করতে পারবো না।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে, বাঁধাগুলোকে আমাদের নিজেদের মধ্যকার বাঁধা হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, অন্তরের প্রশান্তি অর্জনে সবচেয়ে বড় বাঁধাগুলোর একটি হল রাগ। যেমনঃ একজন মানুষ যদি রাগান্বিত হয়ে কাজ করে এবং প্রতিনিয়ত ক্ষোব ঝাড়তে থাকে, তবে ঐ পরিস্থিতিতে সে কীভাবে অন্তরের প্রশান্তি অর্জন করবে? এটা অসম্ভব। তাই ঐ ব্যক্তিকে অনুধাবন করতে হবে যে, অন্তরের প্রশান্তি অর্জনের পথে রাগ একটি বাঁধা।
কিন্তু কোন লোক যদি বলে যে, “হ্যাঁ, এটি একটি বাঁধা, তবে আমি রাগান্বিত হই না,” তবে ঐ লোকের সমস্যা আছে। কারণ, তিনি ঐ বাঁধাটিকে তার নিজের বাঁধা হিসেবে গ্রহণ করেন নি এবং আত্ম অস্বীকৃতির একটি অবস্থায় আছেন। যার কারণে, বাঁধাটি তিনি দূর করতে পারবেন না।
আমরা যদি আমাদের জীবনের বাঁধাগুলোকে লক্ষ্য করি, তবে সেগুলোকে কিছু নির্দিষ্ট শিরোনামের মধ্যে রাখতে পারি। ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিবারিক বিষয়, অর্থনৈতিক সংকট, কাজের চাপ এবং আধ্যাত্মিক বিভ্রান্তি। আর অসংখ্য বিষয়ই এসব শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত।
আমাদের অসংখ্য সমস্যা এবং বাঁধা রয়েছে, যেগুলো অনেকটা অসুস্থতার মত। আমরা যদি সেগুলো একে একে সমাধান করতে যাই, তবে কখনোই সমাধান করতে পারবো না। আমাদেরকে সেগুলো চিহ্নিত করে কিছু সাধারণ তালিকার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং প্রত্যেকটি বাঁধা ও সমস্যা আলাদাভাবে মোকাবেলা না করে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী হিসেবে মোকাবেলা করতে হবে।
আর এ জন্য প্রথমেই আমাদের সেই সকল বাঁধা দূর করতে হবে যেগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমাদেরকে পৃথক করতে জানতে হবে কোন সমস্যাগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আর কোনগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যখন আমরা বুঝতে পারব যে, এই এই সমস্যাগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, প্রকৃতপক্ষে তখন সেগুলো আমাদের কাছে কোন সমস্যাই মনে হবে না। আল্লাহই সেগুলো আমাদের ভাগ্যে রেখেছেন। যদিও সেগুলো বাঁধা নয়, তারপরও আমরা সেগুলোকে বাঁধা হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করি।
উদাহরণস্বরূপ, আজকের দিনে কেউ যদি কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে, যেখানে পৃথিবীতে শ্বেতাঙ্গদের সুবিধা দেওয়া হয় বেশি; অথবা যদি গরীব হিসেবে জন্মগ্রহণ করে, যেখানে ধনীদের সুবিধা দেওয়া হয় বেশি; কিংবা যদি খাটো, খোঁড়া বা অন্য কোন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে- তবে এগুলোকে জীবনের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে গণ্য করা হয়।
উপর্যুক্ত সবগুলো সমস্যাই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমরা বাছাই করিনি কোন পরিবারে আমাদের জন্ম হবে; কিংবা এটাও ঠিক করিনি কোন দেহে আমাদের আত্মা প্রবেশ করানো হবে, কারণ এগুলো আমাদের ইচ্ছাধীন নয়। তাই এই ধরনের যত বাঁধাই আমাদের সামনে আসুক না কেন, আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং বুঝতে হবে, প্রকৃতপক্ষে এগুলো বাঁধা নয়।
“তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।”
[আল-বাক্বারাঃ ২১৬]
তাই যে সকল বাঁধা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আমরা হয়তো সেগুলো অপছন্দ করতে পারি, এবং পরিবর্তন করতে চাই। আর কিছু মানুষ প্রকৃতপক্ষেই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এগুলো পরিবর্তন করার জন্য।
অন্তরের প্রশান্তি অর্জনের একমাত্র উপায় হচ্ছে যে সকল বাঁধা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সেগুলোকে ধৈর্যের আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে মেনে নেয়া।
জেনে রাখুন, যা কিছুই ঘটুক না কেন, যেগুলোর উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, আমাদের চোখে ধরা পরুক বা না পরুক আল্লাহ অবশ্যই এতে ভালো কিছু রেখেছেন। তাই আমরা এটা মেনে নেই!
একবার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল, যেখানে হাস্যোজ্জ্বল এক মিশরীয় ব্যক্তির ছবিও যুক্ত ছিল। মিশরীয় ব্যক্তিটি দুহাত প্রসারিত করে বিজয়ের হাসি হাসছিল; তার এক চিবুকে চুমো খাচ্ছিল তার বাবা আর অন্য চিবুকে বোন।
ছবিটির নিচে একটি শিরোনাম দেয়া ছিল। আগের দিন লোকটির গালফ এয়ার ফ্লাইটের একটি বিমানে কায়রো থেকে বাহরাইন যাওয়ার কথা ছিল। তিনি এয়ারপোর্টে ছুটে গিয়েছিলেন এবং যখন সেখানে পৌঁছালেন, তখন লক্ষ্য করলেন পাসপোর্টের সাথে একটি স্ট্যাম্প তিনি আনতে ভুলে গিয়েছেন (কায়রোতে আপনার কাগজপত্রের সাথে অনেকগুলো স্ট্যাম্প থাকতে হবে)। যেহেতু তিনি বাহরাইনের একজন শিক্ষক ছিলেন, আর বাহরাইনের পথে এটাই ছিল শেষ ফ্লাইট, তাই এই ফ্লাইটে ফিরে যেতে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ তার চাকরি চলে যাওয়া। তাই তিনি বারবার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছিলেন বিমানে তাকে নিয়ে নেয়ার জন্য। তিনি প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছিলেন, কিন্তু প্লেনে উঠতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তাকে ছাড়াই প্লেনটি ছেড়ে গেল।
প্রচণ্ড শঙ্কা নিয়ে তিনি বাসায় ফিরে ভাবছিলেন, তার ক্যারিয়ার বোধয় শেষ। তার পরিবার তাকে সান্তনা দিয়ে বলল, এ ব্যাপারে সে যেন চিন্তা না করে। পরদিন তিনি খবরে শুনলেন, যে প্লেনে তার যাওয়ার কথা ছিল সেটি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং তার সকল যাত্রীই মারা গিয়েছে। আর তখনই তিনি খুব আনন্দিত হলেন, কারণ তিনি সেই ফ্লাইটে যাননি। কিন্তু আগের দিনই তার জীবন শেষ হতে যাচ্ছিল, যেখানে আগের ঘটনাটিও ছিল তার জন্য হতাশাজনক।
এগুলোই সেই ভালোর নিদর্শন। আর এ ধরনের আরও নিদর্শন পাওয়া যায় মূসা (আলাইহিস সালাম) ও খিজির (আলাইহিস সালাম) এর গল্পে (যা আমাদের প্রতি জুমু’আর দিন পড়া উচিত, সূরা আল-কাহাফ)। যখন খিজির (আলাইহিস সালাম), মূসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁকে সাহায্য করতে আগ্রহী মানুষগুলোর নৌকায় ছিদ্র করে দিয়েছিলেন, তখন মূসা (আলাইহিস সালাম) জিজ্ঞাসা করল, কেন সে এমনটি করল?
যখন নৌকার মালিকেরা নৌকার ছিদ্রগুলো দেখল তখন তারা অবাক হল এবং ভাবল কাজটি খুব খারাপ হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই রাজা এসে জোরপূর্বক সবগুলো নৌকা নিয়ে গেল, শুধুমাত্র সেটি ছাড়া যার মধ্যে একটি ছিদ্র ছিল। তাই নৌকার মালিকেরা তাদের নৌকায় ছিদ্র থাকায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। [১]
এরকম আরও অনেক ব্যাপার আছে যেগুলোকে আমরা আমাদের জীবনের বাঁধা বলে মনে করি। আমরা চিহ্নিত করতে পারি না কোন বাঁধাগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমরা জানি না কোন একটি বিষয় ঘটার কারণ, কী তার ব্যাখ্যা। অনেকের ক্ষেত্রে তো এটা তাদের অবিশ্বাসের দিকে নিয়ে যায়। যদি কেউ কোন নাস্তিকের কথা অনুসরণ করে তবে তার অন্তরের প্রশান্তি থাকবে না এবং সে আল্লাহকে ত্যাগ করবে। কেন নাস্তিক লোকটি নাস্তিক হল? আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস করা অস্বাভাবিক, যেখানে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করাটা আমাদের জন্য স্বাভাবিক। কারণ, আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখার একটি সহজাত প্রবৃত্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন,
“তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই আল্লাহর প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।”
[আর-রুমঃ ৩০]
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“প্রতিটি মানব শিশুই মুসলমান হিসেবে জন্মগ্রহণ করে...।”
[সহীহ বুখারী ও মুসলিম]
এটাই মানবজাতির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু একজন মানুষ নাস্তিক হয়ে পড়ে শুধুমাত্র কিছু হতাশাজনক ও বিয়োগাত্মক ঘটনার কারণে। যদি তাদের জীবনে কোন বিয়োগাত্মক ঘটনা ঘটে, তাদের কাছে এর কোন ব্যাখ্যা থাকেন না। যেমনঃ একজন নাস্তিক বলতে পারে তার খুব ভালো এক খালা ছিল যাকে সবাই ভালোবাসতো। কিন্তু একদিন তিনি যখন রাস্তা পার হচ্ছিলেন হঠাৎ কোথা থেকে একটি কার এসে তাকে ধাক্কা দিল এবং তিনি মারা গেলেন। কিন্তু এত মানুষ থাকতে তার ক্ষেত্রেই কেন এটি ঘটল? কেন? কোন ব্যাখ্যা নেই! অথবা একজন নাস্তিকের একটি সন্তান মারা যেতে পারে, কেন আমার সন্তানের ক্ষেত্রে এটা ঘটল? কেন? কোন ব্যাখ্যা নেই! আর এসব বিয়োগাত্মক ঘটনার কারণেই আল্লাহর অস্তিত্ব নেই বলে তারা মনে করে।
চলুন আবার মূসা (আলাইহিস সালাম) ও খিজির (আলাইহিস সালাম) এর ঘটনায় ফিরে যাই, নদী পার হওয়ার পর তাদের সামনে একটি শিশু এসে পড়লো এবং খিজির (আলাইহিস সালাম) তার শিরশ্ছেদ করলেন। মূসা (আলাইহিস সালাম), খিজির (আলাইহিস সালাম) কে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কীভাবে এধরনের একটি কাজ করতে পারলেন? শিশুটি ছিল নিষ্পাপ, কিন্তু খিজির (আলাইহিস সালাম) তার শিরশ্ছেদ করলো! খিজির (আঃ), মূসা (আঃ)-কে বললেন, শিশুটির অবিভাবকরা ছিল ন্যায়পরায়ণ, আর শিশুটি যদি বড় হতো (আল্লাহ জানতেন), তবে সে তার পিতামাতার জন্য এত বড় হুমকি হতো যে, তাঁরা কাফির হয়ে পরতো। তাই আল্লাহ ছেলেটিকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
অবশ্যই অবিভাবকরা তাদের সন্তানকে মৃত অবস্থায় পেয়ে কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ এই সন্তানের পরিবর্তে তাঁদের আরেকটি সন্তান দিল, যে ছিল ন্যায়পরায়ণ এবং তাঁদের জন্য উত্তম। এই সন্তান তাঁদের সম্মানিত করেছিল, যদিও প্রথম সন্তানের জন্য তাঁদের অন্তরে একটি ক্ষত ছিল। আর কিয়ামতের দিন যখন তাঁরা আল্লাহর সম্মুকে দণ্ডায়মান হবেন এবং আল্লাহ তাঁদের সন্তানকে কেড়ে নেওয়ার কারণ জানাবেন, তখন তাঁরা বুঝতে পারবেন এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হবেন।
কিছু বিষয় যেগুলো বাহ্যিকভাবে খারাপ মনে হয়, সেগুলো আমাদের অন্তরের প্রশান্তি অর্জনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ আমরা বুঝতে কেন এগুলো ঘটছে। কিন্তু আমাদেরকে এসব ব্যাপার এড়িয়ে চলতে হবে।
আমাদের বিশ্বাস করতে হবে এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকেই এবং এর পেছনে অবশ্যই ভালো উদ্দেশ্য রয়েছে, তা আমরা দেখতে পাই কিংবা না পাই। তারপর আমরা সেসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করব যেগুলো আমরা পরিবর্তন করতে পারি। প্রথমে আমরা সেগুলোকে চিহ্নিত করব, তারপর অগ্রসর হব দ্বিতীয় পদক্ষেপের দিকে, আর তা হল সমাধান বের করে বাঁধা দূর করা।
পাদটীকাঃ
[১] রাজাটি ছিল অত্যাচারী এবং জোরপূর্বক ভালো নৌকা ছিনিয়ে নেয়ার জন্য পরিচিত ছিল। কিন্তু নৌকার মালিকেরা ছিল খুব গরীব এবং নৌকাই ছিল তাদের একমাত্র সম্বল। তাই খিজির (আলাইহিস সালাম) চাইছিলেন নৌকায় একটি খুঁত ধরা পরুক, যাতে রাজা সেটি নিয়ে যেতে না পারেন এবং তারা তাদের নৌকা থেকে উপকৃত হতে থাকুক।
মূল লেখকঃ ড.আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস
পর্ব ২ » এখানে
[…] পর্ব ১ » এখানে […]
উত্তরমুছুন