বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৩

যেভাবে অন্তরের প্রশান্তি অর্জন করা যায়

মাঝে মাঝে আমরা এমন অনুভব করি যে, সবকিছুই একেবারে অসহ্য!- আমাদের বিশ্বাসে অস্থিরতা, প্রতিনিয়ত একই পাপ করে যাওয়া; অনুভুতিটা এমন হয় যে, “আমি আল্লাহর রহমতের অযোগ্য।”

জীবনের সবগুলো পরীক্ষাই আমাদের কাছে মনে হয় শাস্তি। সবসময় আমাদের মাঝে ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি দুঃশ্চিন্তা থেকেই যায়ঃ আমার পড়াশুনা, ক্যারিয়ার, ধনসম্পদ, বিয়ে… আর কিছু কিছু বাঁধাকে দেখে মনে হয় সেগুলো কাটিয়ে উঠা অসম্ভব। আমরা জানি, আমাদের এই ধরনের প্রশ্ন করা ঠিক নয়, তবুও অন্তরের মাঝে বারবার প্রশ্নটি জেগে উঠেঃ ‘শুধুমাত্র আমিই কেন?’

প্রশান্তিআমরা সকলেই শুনেছি যে, কখনোই আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ হতে নেই। আর বাহ্যিকভাবে আমরা চাইও না হতে, কিন্তু শয়তান সবসময় কৌশলী। আমরা সাধারণত নিজেদের সম্পর্কে এবং কোন কিছু পরিবর্তন করার ব্যাপারে নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে, বিশেষ করে আমরা অন্তরের যে অশান্তি অনুভব করি, সে ব্যাপারে খুবই হতাশাপ্রবণ। আর এর পরিণতি মূলত আল্লাহর রহমতের প্রতি হতাশ হওয়ারই অনুরূপ। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এটা মনে করি না যে, আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে আল্লাহ আমাদের উদ্ধার করতে পারেন এবং নতুন কষ্ট পাওয়ার আখাঙ্ক্ষা করার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। আল্লাহ আমাদের শাস্তি দিচ্ছেন না এবং আমাদেরও পুরোপুরি নিখুঁত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

এর অর্থ এটা নয় যে, আমাদের সংগ্রাম করা উচিত নয়, কিংবা যখনই আমরা কোন ভুল করে বসি, নিজেকে হিসাবের কাঠগরায় দাঁড় করাতে হবে। আর এ ধরনের সমস্যা সমাধানের একমাত্র চাবিকাঠি হল আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি সাধন করা। আমরা যদি আল্লাহকে চিনতে পারি তবে কোন পরিস্থিতিই আমাদের কাছে হতাশাজনক মনে হবে না। কোন দুঃখই চিরস্থায়ী নয়। আমরা আমাদের পরীক্ষাগুলো সেভাবেই সামাল দেই, যেভাবে সেগুলো সামাল দেওয়ার কথা- আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাসের পরীক্ষা হিসেবে, আমাদের প্রতি চাপ প্রয়োগ করা হয়, যাতে আমাওরা আমাদের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারি এবং প্রতিনিয়ত আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারি। এই পরীক্ষাগুলো আমাদের জন্য শাস্তিও হতে পারে যদি আমরা আমাদের দুঃখ কষ্টের কারণে পুরোপুরি আল্লাহর প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ি। কিন্তু নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা এবং আল্লাহর রহমত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আমাদেরকে শাস্তি থেকে ইতিবাচক কিছুর দিকেও নিয়ে আসতে পারে, যা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে সম্ভব, পাশাপাশি ভালো কাজও করা যা আমাদের খারাপ কাজগুলো মুছে দিবে।

প্রথমত আমাদের যে কাজটি অনুশীলন করতে হবে তা হল, সচেতনভাবে বিশ্বাস করা, আল্লাহ সবকিছুই জানেন। যে ধরনের শোকের মধ্য দিয়েই আমরা অতিক্রম করি না কেন, যে ধরনের কষ্টই আমাদের সহ্য করতে হোক না কেন, আমাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, আমরা একা নই। যদি এটাও অনুভব করি যে, পৃথিবী কর্তৃক আমি বর্জিত, তবুও মনে রাখতে হবে আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। পবিত্র কুর’আনে তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন,

"আল্লাহ বলেনঃ তোমরা ভয় করো না, আমি তোমাদের সাথে আছি, আমি শুনি ও দেখি।"


[ত্বা-হাঃ ৪৬]


যখন থেকেই আমরা অনুধাবন করতে শুরু করব যে, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন, তিনি আমাদের অতি সন্নিকটেই, তখন থেকেই আমরা আমাদের অন্তরের দুশ্চিন্তাগুলোর সমাধান খুঁজে পাব। আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের উন্নতির জন্য কিছু বিষয় সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন। তারপর সে কাজগুলো করতে হবে, যেগুলো আল্লাহর সাথে আমাদের এই সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করবে। আর সবশেষে সেই সব জিনিসের আকাঙ্ক্ষা করতে হবে, যেগুলো আল্লাহর সাথে আদর্শ সম্পর্ক স্থাপনে আমাদের সহায়তা করবে। আমরা দু’আ করি এই ধাপগুলো শেষে আমরা যেন আল্লাহর সাথে একটি উত্তম ও শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি।

আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি সাধনঃ


২০০৬ সালের জুলাই মাসে লেবাননের উপর ইসরাইলের বিধ্বংসী আক্রমণের একটি খবর দেখছিলাম। যখন আমি ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষের ছবি ও আর্তপীড়িতদের চিৎকার শুনছিলাম, তখন যে হতাশা ও অসহায়ত্ব আমি বোধ করছিলাম তা ছিল দুঃসহ! তাই আমি কুর’আন তিলাওয়াতের মাধ্যমে দু’আ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি যখন কুর’আন তিলাওয়াত করছিলাম, তখন এই আয়াতটি চোখে পড়ল,

"তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম করনি যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের উপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর এমনি ভাবে শিহরিত হতে হয়েছে যাতে নবী ও তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্যে! তোমরা শোনে নাও, আল্লাহর সাহায্যে একান্তই নিকটবর্তী।"


[আল-বাক্বারাহঃ ২১৪]


আর সেটাই ছিল উত্তর। মানুষ হিসেবে আমাদের পরীক্ষার সম্মুখীন করা হবে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমাদেরকে সারা জীবন কষ্টের মধ্যে কাটাতে হবে, কারণ, ‘নিঃস্বন্দেহে আল্লাহর সাহায্য অতি সন্নিকটে।’  তাহলে কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করার মানে কী? আল্লাহ কি আমাদের প্রতি রাগান্বিত? কী হবে যদি এই কষ্ট থেকে মুক্তির কোন পথ না থাকে?

যখনই আমরা কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করি, তখন কিছু বিষয়ে আমাদের পরিষ্কার জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আল্লাহ আমাদের পবিত্র কুর’আনে বলেছেন,

"বিত্তশালী ব্যক্তি তার বিত্ত অনুযায়ী ব্যয় করবে। যে ব্যক্তি সীমিত পরিমাণে রিযিকপ্রাপ্ত, সে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তা থেকে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যা দিয়েছেন, তদপেক্ষা বেশী ব্যয় করার আদেশ কাউকে করেন না। আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেবেন।"


 [আত-তালাক্বঃ ৭]


কিছু কিছু কষ্ট এতটাই যন্ত্রণাদায়ক যে, বাধাবিঘ্ন ছাড়া কোন কিছুতেই আমরা মনোযোগ দিতে পারি না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যদি আল্লাহর নিয়ামতগুলোর তালিকা করতে যাই, তবে সেগুলো আমরা কোনদিনই গুণে শেষ করতে পারব না। নিজেদেরকে জীবনের অন্যান্য নিয়ামতগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, যেগুলো আমাদেরকে বর্তমান পরিস্থিতি ছাপিয়ে বৃহৎ প্রাপ্তিগুলোর পরিতৃপ্তি এনে দিবে। আর ঠিক সিজদায় গিয়ে হৃদয় থেকে বলা, “হে আল্লাহ!” আর এটি একটি রহমত যা অন্য সবকিছুকেই ছাড়িয়ে যায়।

কিন্তু কেন এত পরীক্ষা?


সকল পরীক্ষার পেছনেই একটি উদ্দেশ্য আছে, আর এই উদ্দেশ্যের সম্পর্ক রয়েছে আমাদের অন্তরের অবস্থা এবং আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের সাথে। আল্লাহর ৯৯ টি (গুণবাচক) নাম রয়েছে, আর এতে আমাদের পরিতৃপ্ত হওয়া উচিত যে, তিনি সর্বাপেক্ষা দয়াময়, সর্বোত্তম ন্যায় বিচারক এবং সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী। আপনাকে এই পরীক্ষাগুলোর সম্মুখীন করছেন কোন সাধারণ মানুষ নয়, বরং আল্লাহ, যিনি আমাদের ঘাড়ের শিরার চেয়েও অতি নিকটবর্তী অর্থাৎ যিনি আমাদের অন্তর ও বাহিরের সবকিছুই জানেন।


পরীক্ষাগুলো আমাদের আত্মশুদ্ধির একটি উপায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

"মুসলিম ব্যাক্তির উপর যে সকল যাতনা, রোগ ব্যাধি, উদ্দেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আপতিত হয়, এমন কি যে কাটা তার দেহে বিদ্ধ হয়, এ সবের দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহ সমুহ ক্ষমা করে দেন। "


[সহীহ বুখারীঃ ৫২৩৯]


আমাদের একমাত্র লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জান্নাত লাভ করা, কিন্তু আমরা প্রকৃতভাবে যেভাবে আল্লাহর ইবাদত করা উচিত সেভাবে করতে ব্যর্থ হই। আমাদের অনেকেই নিয়মিত আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা, নিজেদের অবস্থা তাঁর কাছে তুলে ধরা কিংবা তাঁর নিকট প্রত্যাবর্তনে ব্যর্থ হই। ইহজীবনের এই পরীক্ষাগুলো যত কঠিন হবে, শেষ বিচারের দিন পরীক্ষাগুলো হবে ততই সহজ, যদি আমরা ধৈর্য ধারণ করে সেগুলো অতিক্রম করি।

আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও এসব পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা যখন আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে যাই, তখন আমাদেরকে পূণরায় আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। যে ধরনের দুঃশ্চিন্তাতেই আমরা নিমজ্জিত হই না কেন, পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে আমাদের অনুধাবন করা উচিত, আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই, একেবারেই কেউ নেই।

আমরা যদি আল্লাহর নিকটবর্তী হয়ে থাকি, তবে এই কষ্ট কিংবা বাধাবিঘ্নগুলো হচ্ছে আমাদের স্থিতিশীলতার পরীক্ষা। আমরা কি শুধু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময়ই আল্লাহর নিকটবর্তী থাকব? নাকি কষ্টের সময়ও আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়? যখন আমরা কোন পরীক্ষার সম্মুখীন হই তখন কি আমরা যে সব ভাল কাজ করতাম সেগুলো ত্যাগ করি?  আল্লাহ ঐ ধরনের মানুষদের সম্পর্কে নিচের আয়াতে বলেছেন,

"মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহর এবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয়, তবে এবাদতের উপর কায়েম থাকে এবং যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি।"


[আল-হজ্জঃ ১১]


এটা হয়তো অস্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু অনেক সময় আল্লাহ তাঁর ভালোবাসার কারণেও মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তিনি তাকে পরীক্ষা করেন।


[আত-তিরমিযি]


এক হাদীসে এসেছে, একবার আল্লাহ জীবরাইল আলাইহিস সালামকে এক বান্দার দু’আর প্রতিদান প্রদানে বিলম্ব করতে বলেছিলেন, কারণ আল্লাহ তাঁর কণ্ঠ শুনতে পছন্দ করতেন।

তাই আমাদের সকলেরই উচিত সবসময় আল্লাহর সেই অমূল্য বাণী স্মরণে রাখা,

"নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।"


[আল-ইনশিরাহঃ ৬]


আল্লাহ আমাদের সকলকেই জীবনের কষ্টগুলোকে ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করার তৌফিক দান করুক।

আমীন।

[১] আত-তাবারানি

পাদটীকাঃ
উৎসঃ লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে OnIslam.net ওয়েব সাইট থেকে।

0 on: "যেভাবে অন্তরের প্রশান্তি অর্জন করা যায়"