কুরআনকে যারা পথ নির্দেশক ও আরোগ্য লাভের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে তাদের উপর কুর’আনের এক অদ্ভুত ও মৌলিক প্রভাব রয়েছে। কুর’আন তাদের চরিত্রকে নতুন রূপ দান করে এবং এমনভাবে পূণর্গঠিত করে যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ভালোবাসেন। কুর’আনের প্রভাব সম্পর্কে যাদের সংশয় রয়েছে তাদের উচিত সাহাবাদের রাদিয়াল্লাহু আনহুগণের জীবনে কী ঘটেছিল তা বিবেচনা করা।
ইসলামে আসার পূর্বে সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুগণ শোচনীয় ও অজ্ঞ জীবন যাপন করতেন। কুর’আনের প্রভাবে তাদের জীবনে যে পরিবর্তন এসেছিলো তা-ই এর পরিবর্তন ও পূণর্গঠন করার ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। এরই প্রভাবে মরুচারী নিঃস্ব, নগণ্য, নগ্নপদ মানুষগুলো পরিণত হয়েছিলো এক নতুন সৃষ্টিতে; তাদের উচ্চাভিলাষ পরিণত হয়েছিলো মহিমান্বিত লক্ষ্যে এবং তাদের হৃদয়গুলো উন্নীত ও সংযুক্ত হয়েছিলো আল্লাহর পানে। আর তাদের আত্মা পরিবর্তিত হওয়ার মাধ্যমে সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো আল্লাহর প্রতিশ্রুতিঃ
আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।
[সূরা আর-রাদঃ ১১]
এভাবেই কয়েক বছরের মধ্যেই আরবের মরুভূমি থেকে উত্থিত হয়েছিলো এক শক্তিশালী বাহিনী যারা জয় করে নিয়েছিলো শক্তিশালী রাজত্ব এবং ছিনিয়ে নিয়েছিলো নেতৃত্ব।
কুর’আন কী করে এমন নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলো? প্রকৃতপক্ষে যা কুর’আনকে এতোটা কার্যকর করেছিলো তা হলো কুর’আনের প্রতি নবী ﷺ এর সাহাবাদের সর্বোত্তম সান্নিধ্য। তাঁরা কুর’আনকে বুঝেছিলেন এবং এর মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন নবী ﷺ কে একমাত্র আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে।
নবী মুহাম্মাদ ﷺ কুর’আনের উপর জীবন-যাপন করেছেন এবং এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, কুর’আন যা কিছুর অনুমোদন দিয়েছে তিনি তা অনুমোদিত করেছেন এবং যা কিছু নিষেধ করেছে তিনিও তা নিষেধ করেছেন। তাই ‘আইশা রাদিয়াল্লাহু আনহা যে তাঁকে “দুনিয়ার বুকে চলমান কুর’আন” বলে আখ্যা দিয়েছেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
নবী ﷺ ধীরে ধীরে ও পরিষ্কারভাবে কুর’আন তিলাওয়াত করতেন। এক রাতে তিনি নিচের আয়াতটি অনেকবার পুনরাবৃত্তি করেছিলেনঃ
যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ।
[সূরা মায়্যিদাহঃ ১১৮]
কুর’আন নবী ﷺ এর উপর এমনি দারুণ প্রভাব ফেলেছিলো যে তিনি বলেন,
সূরা হুদ, সূরা ওয়াকিয়াহ, সূরা মুরসালাত, সূরা নাবা ও সূরা কুব্বিরাতের ভয়াবহতায় আমাকে বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে।
অর্থাৎ সূরা হুদ এবং এর মতো অন্য সূরাগুলোতে কিয়ামত ও পূর্ববর্তী জাতিদের কী হয়েছিলো তার যে মর্মান্তিক বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা শুধু নবী ﷺ এর আধ্যাত্মিকতার উপরই প্রভাব ফেলেনি, বরং তাঁর শারীরিক পরিবর্তনও ঘটিয়েছিলো।
সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুগণও নবী ﷺ এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। তাঁরাও কুর’আনের মিষ্টত্ব আস্বাদন করেছিলেন এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে ‘আব্বাদ ইবনে বিশর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনাটি উল্লেখ করার মতো। কোনো এক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পথে নবী ﷺ ‘আব্বাদ এবং ‘আম্মার ইবনে ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাতে ছাউনি পাহারা দেয়ার জন্য নিযুক্ত করলেন। ‘আব্বাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাতের প্রথম ভাগের দায়িত্ব নিলেন, ফলে ‘আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘুমিয়ে পড়লেন।
জায়গাটি নিরাপদ মনে হওয়ায় ‘আব্বাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সালাতের মাধ্যমে সময় কাটাতে লাগলেন। কিন্তু এক মুশরিক ছাউনির প্রতি লক্ষ্য রাখছিলো এবং ‘আব্বাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে একটি তীর ছুঁড়লো। ‘আব্বাদ তাঁর শরীর থেকে তীরটি খুলে আবার সালাত আদায় করতে লাগলেন। মুশরিকটি আবার তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়লো এবং ‘আব্বাদ পুনরায় তীরটি খুলে সালাত আদায় করতে লাগলেন। মুশরিকটি তৃতীয়বারের মতো ‘আব্বাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়লে কেবল তখনই তিনি তিলাওয়াত থামিয়ে রুকু ও সিজদাহ করলেন এবং ‘আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জাগিয়ে তুললেন। ‘আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন জিজ্ঞেস করলেন কেনো প্রথম তীরের আঘাতের সাথে সাথেই তাঁকে জাগিয়ে দেয়া হয়নি, ‘আব্বাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাব দিলেন,
আমি একটি সূরা তিলাওয়াত করছিলাম এবং চাচ্ছিলাম না কোনো প্রকার বিঘ্ন ঘটুক। কিন্তু যখন লোকটি (মুশরিকটি) আমাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তেই থাকলো আমি আপনাকে জাগিয়ে দিয়েছি। আল্লাহর কসম, যদি নবী ﷺ আমাকে (ছাউনি পাহাড়া দেয়ার) যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা ঝুঁকিগ্রস্ত হওয়ার ভয় না থাকতো, তবে আমি আমার তিলাওয়াত থামাতাম না যতক্ষণ না আমি আমার তিলাওয়াত সম্পন্ন করতাম কিংবা সে আমাকে হত্যা করতো।
উপরোক্ত উদাহরণ এটাই প্রমাণ করে যে নবী ﷺ এবং সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুগণের নিকট কুর’আন তিলাওয়াত কেবলি মৌখিক প্রতিশ্রুতির ব্যাপার ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে কুর’আনের আসল মূল্য নিহিত রয়েছে এর অর্থ এবং পাঠকের পরিবর্তনে এর প্রভাব বিস্তারের সামর্থ্যের উপর। কুর’আনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বাসীদের হৃদয় পুনর্জাগরিত করা এবং তাদের মানসিকতাকে পুনর্গঠিত করা। এর ফলে এমন মানুষ তৈরি হবে যারা আল্লাহকে জানবেন এবং আন্তরিকতার সাথে তাঁর ইবাদাত করবেন। কিন্তু এমন ফল কেবল চিন্তাহীন কুর’আন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সম্ভব নয়, তা কেউ সম্পূর্ণ কুর’আন হাজার বার তিলাওয়াত করলেও না।
সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুগণ বার বার এই ব্যাপারটির সত্যতাজ্ঞাপন করেছেন। একবার ‘আইশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে কিছু লোক সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিলো যারা প্রতি রাতে দু থেকে তিনবার কুর’আন খতম করতো। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য ছিলো, “বাহ্যত তারা তিলাওয়াত করে থাকে ঠিক, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা যেন কিছুই পড়লো না।” তারপর তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কীভাবে শুধুমাত্র সূরা আল-বাক্বারা, আল-ইমরান ও আন-নিসা তিলাওয়াত করে সারারাত কাটাতেন তার উল্লেখ করলেন। কুর’আন তিলাওয়াতের সময় তিনি যখন কোনো সুসংবাদের আয়াত তিলাওয়াত করতেন তখন আল্লাহর কাছে রহমতের জন্য দু’আ করতেন, আর তিনি যখন কোনো ভয়ের আয়াত তিলাওয়াত করতেন তখন আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন।
আবু জামরা একবার ইবনে ‘আব্বাসকে রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছিলেন, “আমি খুব দ্রুত কুর’আন তিলাওয়াত করতে পারি এবং সম্পূর্ণ খতম করতে আমার মাত্র তিনদিন সময় লাগে।” ইবনে ‘আব্বাস জবাব দিলেন, “আমার নিকট সারারাত যথাযথ মনোযোগ ও সঠিকভাবে (কেবল) সূরা আল-বাক্বারাহ তিলাওয়াতই উত্তম।”
আল-আজরি তাঁর কুর’আনের বাহকদের নৈতিকতা গ্রন্থে বলেন,
সতর্কতা ও গভীর চিন্তার সাথে কুর’আনের একটি ক্ষুদ্র অংশ তিলাওয়াত, চিন্তাভাবনা ছাড়া একটি বৃহৎ অংশ তিলাওয়াতের চাইতে উত্তম। কুর’আন, সুন্নাহ এবং ‘আলিমদের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বিষটির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
মুজাহিদকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো দুজন ব্যক্তির মধ্যে কে উত্তম যারা সালাতে একই সময় ব্যয় করে, রুকু ও সিজদাহর সময়ও এক, কিন্তু তাদের একজন কেবল সূরা বাক্বারা তিলাওয়াত করে এবং অন্যজন (একই সময়ে) সূরা বাক্বারা ও আল-ইমরান তিলাওয়াত করে। মুজাহিদ বলেন, “যিনি কেবল সূরা বাক্বারা তিলাওয়াত করেন তিনিই উত্তম।” তিনি তাঁর মতকে সমর্থন করেছিলেন এই আয়াতের ভিত্তিতেঃ
আমি কুর’আনকে যতিচিহ্ন সহ পৃথক পৃথকভাবে পাঠের উপযোগী করেছি, যাতে আপনি একে লোকদের কাছে ধীরে ধীরে পাঠ করেন এবং আমি একে যথাযথ ভাবে অবতীর্ণ করেছি।
[সূরা আল-ইসরাঃ ১০৬]
মূল লেখক | অনুবাদ সহযোগীতা | উৎস |
---|---|---|
ড. মাগদি আল-হিলালি | ইমরান হেলাল | www.OnIslam.net |
0 on: "কুর’আন - পরিবর্তনের অনুপ্রেরক"