বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

৭ টি টিপসঃ যেভাবে ফজরের সালাতের পর জেগে থাকা যায়



আসসালামু আলাইকুম,
আশা করি সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। আমার আজকের লেখা ফজরের সালাতের পর জেগে থাকা সম্পর্কিত কিছু টিপস ও ফযীলতকে ঘিরে। বেলা করে ঘুম থেকে উঠার মতো অন্য কোন কিছুই আপনার দৈনন্দিন কর্মতৎপরতাকে ধ্বংস করে না। অফিস কিংবা ক্লাসের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে কোন রকমে জামা-কাপড় পড়ে, খেয়ে না খেয়ে ছুটে গিয়ে বাস ধরা- একটি কর্মময় দিনের লক্ষণ নয় নিশ্চয়? হাঁপাতে হাঁপাতে যখন অফিস কিংবা ক্লাসে গিয়ে পৌঁছালেন, স্থির হয়ে বসার ঠিক আগ মুহূর্তেই দেখলেন দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল, তারপর ইশার আযান। আপনার মনে হতে লাগলো পুরো দিনটাই ছিল অসম্পূর্ণ। আর এর পেছনে মূল কারণ হল, আপনার হাতে ২-৫ ঘন্টার মত সময় ছিল যা কাজে লাগিয়ে আপনি বাড়াতে পারতেন নিজের কর্মতৎপরতা, কিন্তু সে সময়টা আপনি কাটিয়েছেন ঘুমিয়ে!

ধরতে পারছেন, আমি কোন সময়টার কথা বলছি? আমি কথা বলছি ফজরের সালাতের ঠিক পরবর্তী সময়টি নিয়ে। এটি একটি বরকতময় সময়, যার সম্পর্কে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুআ করেছেন এবং বলেছেন,

হে আল্লাহ! আমার উম্মাতকে সকালের উত্তম সময়ের রহমত দান করুন।

তাহলে আসুন, জেনে নেই সেই ৭ টি কাজ সম্পর্কে যেগুলো আপনাকে সাহায্য করবে ফজরের সালাতের পরও জেগে থাকতে। আর ইনশা আল্লাহ আপনার দিনকে করে তুলবে বরকতময় এবং সফল।

ভোর. তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন এবং বিশ্রাম নিনঃ ইশার সালাতের পর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তায় নিজেকে জড়াতেন না এবং সালাত শেষে, ঘুমানোর জন্য সোজা বাড়ি ফিরে যেতেন। একই ধরনের জীবন প্রবাহ রয়েছে সে সকল সম্প্রদায়ের মাঝে যাদের অঞ্চলে বিদ্যুৎ এখনও মিথ্যা দিবালোকের জন্ম দেয়নি (আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে গেলে এমনটি দেখা যায়)এ সব অঞ্চলের মানুষ সূর্যাস্তের সাথে সাথে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে ফেলে এবং ইশার সালাতের পরপরই খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই ঘুম থেকে উঠে ফজরের সালাতের পর জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। বাড়তি ঘুমানো (ফজরের সালাতের পর যে ঘুম) যদি আপনার একেবারে জরুরি হয়ে পড়ে তবে যুহরের আগে কিংবা পরে সামান্য ভাতঘুম দিতে পারেন।

. আপনার তিনটি গিট খুলে ফেলুনঃ আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

তোমাদের কেউ যখন নিদ্রা যায় তখন শয়তান তার মাথার শেষাংশে তিনটি করে গিট দিয়ে দেয়। প্রত্যেক গিটের সময় এ কথা বলে কুমন্ত্রণা দেয় যে, এখনো রাত অধিক রয়ে গেছে, অতএব শুয়ে থাক। এরপর সে লোক যদি জেগে উঠে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে তখন একটি গিট খুলে যায় (এবং অলসতা দূর হয়)।  তারপর সে যদি উযূ করে, তবে দ্বিতীয় গিটটিও খুলে যায় (এটা অপবিত্রতার গিট); আর যদি সে সালাত আদায় করে তবে সব কয়টি গিটই খুলে যায়। আর তখন তার প্রভাত হয় প্রফুল্ল মনে ও নির্মল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলুষিত মনে ও অলসতা নিয়ে।
[সহিহ বুখারী :: খন্ড ৪ :: অধ্যায় ৫৪ :: হাদিস ৪৯১]

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে শয়তান আমাদেরকে আল্লাহর ইবাদাত করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছে এবং বঞ্চিত করতে চাইছে একটি সুন্দর ও সফল সকাল থেকে। শয়তান যত চেষ্টাই করুক না কেন, আলহামদুলিল্লাহ! আমাদেরকে তার ওয়াসওয়াসার বিরুদ্ধে লড়াই করার অস্ত্র সম্পর্কেও জানিয়ে দেয়া হয়েছেঃ

ক. আল্লাহর প্রশংসা উচ্চারণ করুনঃ
আলহামদু লিল্লাহ-হিল্লাযী আহইয়া-না বাদা মা আমা-তানা ওয়া ইলাইহিন নুশূর।
[বুখারীঃ ৬৩১৪, ৬৩২৫; মুসলিমঃ ৪/২০৮৩]

অর্থঃ সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর জন্য যিনি আমার (নিদ্রারূপ) মৃত্যুর পর আমাকে (পুনর্জাগরিত করে) জীবিত করলেন, আর তাঁরই নিকট (আমাদের) সকলের পুনরুত্থান হবে।
খ. উযূ করুন
গ. সালাত আদায় করুন

আর সালাত আদায়ের পর নিজেকে পুনরায় বিছানায় ফিরে যেতে দিবেন না। এর জন্য দরকার হলে চোখেমুখে পানি দিন, সামান্য কিছু খান কিংবা পান করুন। এগুলো আপনার অলসতা দূর করতে সাহায্য করবে।

. ফজরের পর নির্ধারিত যিকরগুলো করুনঃ আপনার যদি এখনও ফজরের সালাতের পর পূণরায় উষ্ণ বিছানায় ফিরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভূত হয় তবে সেই বাড়তি সওয়াবের কথা ভাবুন যা আপনি সামান্য যিকর ও দুআর মাধ্যমে অর্জন করতে পারেন।

তোমাদের কেউ যতক্ষণ তার সালাতের স্থানে থাকে তার উযূ ভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য ফিরিশতাগণ এ বলে দুআ করতে থাকে যে, ইয়া আল্লাহ! আপনি তাকে মাফ করে দিন, ইয়া আল্লাহ! আপনি তার উপর রহম করুনআর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সালাতই তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়া থেকে বিরত রাখে, সে সালাতে রত আছে বলে গণ্য হবে।
[সহীহ বুখারী :: খন্ড ১ :: অধ্যায় ১১ :: হাদিস ৬২৮]

আর সালাতের পর কোন দুআগুলো পাঠ করা উত্তম তা জানার জন্য আপনি পড়তে পারেন হিসনুল মুসলিম নামক ছোট্ট বইটি।

তাছাড়া আপনি যত দীর্ঘ সময় ধরে জেগে থাকবেন আপনার পূণরায় ঘুমাতে যাওয়ার ইচ্ছা ততই কমতে থাকবে।

. চাশ্‌ত-এর সালাত আদায়ের লক্ষ্য স্থির করুনঃ চাশ্‌তের সালাত হচ্ছে একটি নফল সালাত যা সূর্যোদয়ের আনুমানিক ২০ মিনিট পর থেকে যুহরের ৪৫ মিনিট আগ পর্যন্ত যেকোন সময় আদায় করা যায়। আর এর সওয়াব হচ্ছে দেহের প্রতিটি হাড়ের পরিবর্তে সাদাকাহ দান করার সমান। হযরত আবু যার জুনদুব ইবনে জুনাদা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

তোমাদের যে কোন লোকেরই শরীরের প্রতিটি গ্রন্থির ওপর সাদাকাহ (ওয়াজিব) হয়। সুবহান আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার- এসবের প্রতিটি (কথাই) এক একটি সাদাকাহ। সৎকাজের আদেশ দেয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করাও সাদাকাহ। আর এসব চাশ্‌ত-এর (দুপুরের পূর্বের) দু রাকাআত নামায পড়লেই আদায় হয়ে যায়।
[রিয়াযুস স্ব-লিহীন :: বই ১ :: হাদিস ১১৮]

কে না এই পুরস্কার পেতে চায়?

আর চাশ্‌তের সালাত আদায় করার সময় হতে হতে আপনি আপনার সকালের যিকরও শেষ করে ফেলতে পারবেন।

. কুরআনের কিছু অংশ তিলাওয়াত/মুখস্থ করুনঃ ফজরের সালাতের পরবর্তী সময়টি একাকী কুরআন তিলাওয়াতের জন্য একটি অসাধারণ সময়। দিনের কর্মব্যস্ততা আপনাকে গ্রাস করার আগে আগে এই সময়টাকে কাজে লাগান কুরআনের কিছু অংশ তিলাওয়াত কিংবা মুখস্থ করার মাধ্যমে। সত্যি বলতে, আমি যদি ভোরে কুরআনের কিছু অংশ তিলাওয়াত না করি, তবে দিনের অন্য কোন সময় কিংবা কাজ শেষে তিলাওয়াতের জন্য সময় বের করা আমার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বাস করুন, আপনি যদি আপনার প্রতিটি দিন আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে শুরু করতে পারেন তবে খুব দ্রুতই অনুভব করতে পারবেন এর উপকারিতা।

. হালকা ব্যায়াম করুনঃ সকালে সামান্য হাঁটা কিংবা হালকা ব্যায়াম আপনার রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করবে। এতে আপনি হয়ে উঠবেন সজীব এবং প্রাণবন্ত। আর ইনশা আল্লাহ সতেজতা অনুভব করবেন যে কোন কাজে।

. একটি কর্ম তালিকা করুনঃ আপনার কি কখনও এমন হয়েছে যে, আপনি ঘুম থেকে উঠেছেন তাড়াতাড়ি, কাজ করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত, কিন্তু কী করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না? আপনার যদি একটি দৈনন্দিন কর্ম তালিকা না থাকে তবে অনিবার্যভাবেই আপনি অনেক সময় অপচয় করবেন এবং আপনার অধিকাংশ কাজই হবে অর্ধ-সমাপ্ত। তাই চাশ্‌তের সালাতের পর দিনের প্রথম কাজ হিসেবে একটি দৈনন্দিন কর্ম তালিকা তৈরি করুন, আরও ভালো হয় যদি কাজটি আপনি আগের দিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে সম্পন্ন করে ফেলুন। অফিস কিংবা ক্লাসে যাওয়ার আগে অন্তত ৩-৫ টি কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য স্থির করুন।

কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর স্মরণ (যিকর), নফল সালাত, কর্ম তালিকা থেকে কিছু কাজ করার মাধ্যমে অফিস কিংবা ক্লাসে যাওয়ার আগেই আপনি হয়ে উঠছেন সজীব, প্রাণবন্ত এবং কর্মতৎপর! আর আপনার সামনে এখনও পড়ে রয়েছে সম্পূর্ণ দিন...

হে আল্লাহ! আমাদেরকে সকলকে সকালের উত্তম সময় থেকে ফযীলত লাভের তৌফিক দান করুন। আমীন।

পাদটীকাঃ

মূল লেখকঃ আমিরা মারফি

উৎসঃ ProductiveMuslim.com

0 on: "৭ টি টিপসঃ যেভাবে ফজরের সালাতের পর জেগে থাকা যায়"