বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০১৪

কঠিন পরীক্ষা



ইখলাস ও আল্লাহভীতির প্রকৃত নিদর্শনগুলোর একটি হলো অবৈধ উপার্জন এড়িয়ে চলা। একজন ঈমাদার বান্দা অসৎ উপার্জনের চাইতে দুঃখ-কষ্টকেই উত্তম মনে করেনইমাম ইবনে জারির আত-তাবারি এ সম্পর্কে একটি হৃদয়স্পর্শী ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

হজ্জের মৌসুমে আমি মক্কায় ছিলাম এবং দেখলাম খুরাসানের এক লোক মানুষকে ডেকে বলছে, হে হাজ্জী ও মক্কাবাসী! যারা এখানে উপস্থিত এবং যারা দূরে অবস্থান করছেন - আমি একটি ব্যাগ হারিয়েছি যাতে এক হাজার দিনার ছিলো। যে ব্যক্তি ব্যাগটি ফেরত দিবে আল্লাহ তাকে উত্তম পুরষ্কার দিবেন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন; আর কিয়ামতের দিন তিনি আল্লাহর দয়া ও সাহায্য লাভ করবেন।

মক্কাবাসীদের মধ্য থেকে এক বৃদ্ধলোক তার কাছে গিয়ে বললো, হে খুরাসানী, আমাদের শহর খুব কঠিন সময় পার করছে, আর হজ্জের মৌসুমও নির্দিষ্ট ও সীমিত এবং আমাদের আয়ের পথও বন্ধ। আপনার হারানো টাকা হয়তো এমন কোনো মুমিনের হাতে পড়েছে যে গরীব ও বৃদ্ধ। সে হয়তো আপনাকে আপনার টাকা ফিরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে, যদি আপনি তা থেকে কিছু অর্থ তাকে দান করেন ফলে ঐ অর্থ ব্যয় করা তার জন্য হালাল হবে
At-Talaq: 2-3 
খুরাসানী লোকটি জিজ্ঞেস করলো, সে কতো টাকা চায়?

মোট অর্থের এক-দশমাংশ।

খুরাসানী লোকটি জবাব দিলো, না, আমি তাকে কোনো অর্থ দিতে পারবো না। বরং আমি আমার দাবি আল্লাহর কাছে জানাবো এবং যেদিন তাঁর সাথে আমি মিলিত হবো সেদিন আমার অভিযোগ তাঁর সামনে পেশ করবো। আর আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বাধিক বিশ্বস্ত।

আমি বুঝতে পারলাম ইনিই সেই লোক যিনি দিনারের ব্যাগটি নিয়েছেন এবং তা থেকে কিছু অংশ দাবি করছেন। তাই তার বাড়ি ফিরে যাওয়া পর্যন্ত আমি তাকে অনুসরণ করলাম এবং আমার ধারণা সত্য প্রমাণিত হলো। আমি শুনলাম লোকটি তার স্ত্রীকে ডাকছে, লুবাবাহ!

তার স্ত্রী বললেন, হে আবু গাইস, আমি আপনার সেবায় হাজির।

বৃদ্ধ লোকটি বললো, আমি দিনারের মালিককে খুঁজে পেয়েছি এবং তিনি সেগুলো ফেরত চাইছেন, কিন্তু যিনি সেগুলো কুড়িয়ে পেয়েছেন তাকে কোনো পুরষ্কার দিতে চাইছেন না। আমি তাকে একশত দিনার দিতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বলেছেন তিনি তার দাবি আল্লাহর কাছে জানাবেন। আমার কী করা উচিত লুবাবাহ? আমাকে অবশ্যই তা ফিরিয়ে দিতে হবে, কারণ আমি আমার রব ও পাপ বেড়ে যাওয়াকে ভয় করি।

তার স্ত্রী বললো, হে আবু গাইস! গত ৫০ বছর ধরে আমরা আপনার সাথে দারিদ্রতার কারণে  সংগ্রাম করে আসছি। আপনার রয়েছে চারটি মেয়ে, দুটি বোন, আমার মা এবং আমি, আর আপনি সহ আমরা মোট নয়জন। টাকাগুলো আপনি রেখে দিন এবং আমাদের আহারের ব্যবস্থা করুন, কারণ আমরা ক্ষুধার্ত, আমাদের পরিধেয় বস্ত্রের ব্যবস্থা করুন, আমাদের অবস্থা তো আপনিই ভালো জানেন। হতে পারে কোনো একদিন আল্লাহ আপনাকে  সম্পদশালী  করবেন তখন আপনি আপনার সন্তান-সন্ততিকে খাইয়ে তার অর্থ তাকে ফেরত দিতে পারবেন অথবা কিয়ামতের দিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনার ঋণ শোধ করে দিবেন।

বিস্মিত হয়ে বৃদ্ধ লোকটি বললো, জীবনের ৮৬ বছর পার করে এখন আমি হারাম গ্রহণ করবো? দারিদ্রতাকে ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করে কবরের সন্নিকটে এসে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আগুনে জ্বালাবো এবং আল্লাহর রোষানলের স্বীকার হবো? নাহ্‌! আল্লাহর কসম, আমি এমনটি করবো না!

বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার অবস্থা দেখে আমি বিস্মিত হলাম। পরবর্তীতে আমি আবার সেই খুরাসানী লোকটিকে চিৎকার করে বলতে শুনেছি, হে মক্কাবাসী ও হাজ্জীগণ! তোমাদের মাঝে কেউ যদি ১০০০ দিনারসহ একটি ব্যাগ পেয়ে থাকে তবে সে যেনো তা ফেরত দেয়। আর নিশ্চয় সে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম পুরষ্কার প্রাপ্ত হবে।

বৃদ্ধ লোকটি বললো, হে খুরাসানী! অন্য একদিন আমি আপনাকে বলেছিলাম আমাদের জমিগুলো চাষাবাদের উপযোগী নয় এবং পরামর্শ দিয়েছিলাম, যে ব্যক্তি ব্যাগটি পেয়েছে তাকে পুরষ্কৃত করতে যাতে তাকে আল্লাহর আইন অমান্য করতে না হয়। আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে ব্যক্তি ব্যাগটি পেয়েছে তাকে ১০০ দিনার দিতে। কিন্তু আপনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেনযদি আপনার ব্যাগটি কোনো মুমিনের হাতে গিয়ে থাকে এবং সে তা ফিরিয়ে দেয় তবে কি আপনি তাকে ১০০ দিনার না হোক, অন্তত ১০ দিনার দেবেন?

খুরাসানী লোকটি জবাবে বললো, আমি এমনটি করবো না এবং যেদিন আল্লাহর সাথে মিলিত হবো সেদিন এ ব্যাপারে তাঁর কাছে অভিযোগ করবো। আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বাধিক বিশ্বস্ত।

লোকটি হতাশ হয়ে চলে গেলো। পরবর্তীতে খুরাসানী লোকটি আবার একই ঘোষণা দিলো।

বৃদ্ধ লোকটি আবার এসে বললো, হে খুরাসানী, গত পরশু আমি আপনাকে বলেছিলাম, যে লোক আপনার ব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছে তাকে ১০০ দিনার দিতে। কিন্তু আপনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেনতারপর বলেছিলাম ১০ দিনার দিতে। আপনি তা-ও মেনে নেননিআপনি কি তাকে মাত্র এক দিনার দেবেন যার অর্ধেক দিয়ে সে ভেড়ার দুধ কিনতে পারে। ফলে তার পরিবার ও সন্তানরা তা খেতে পারবে?

খুরাসানী লোকটি আগের মতো একই জবাব দিলো।

রাগান্বিত কণ্ঠে বৃদ্ধ লোকটি বললো, আমার সাথে এসে আপনার অর্থ নিয়ে যান যাতে রাতে আমি ঘুমাতে পারি। যেদিন আমি ব্যাগটি পেয়েছি সেদিন থেকেই আমার শান্তি চলে গিয়েছে।

ফলে ব্যাগের মালিক বৃদ্ধ লোকটির সাথে গেলো এবং আমি তাদের অনুসরণ করলাম। বাড়ি পৌঁছে বৃদ্ধ লোকটি মাটিতে গর্ত খুঁড়লো এবং দিনারের ব্যাগটি বের করে বললো, এই নিন আপনার ব্যাগ, আর আল্লাহর কাছে দুআ করুন যাতে তিনি আমাকে ক্ষমা করেন এবং তার দয়ার ভাণ্ডার থেকে রহমত দান করেন।

ব্যাগটি নিয়ে খুরাসানী লোকটি চলে যেতে উদ্যত হলো, কিন্তু দরজায় পৌঁছে বলে উঠলো, মারা যাওয়ার সময় আমার পিতা (তার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক) তিন হাজার দিনার রেখে গিয়েছেন এবং আমাকে বলে গিয়েছেন এই অর্থ থেকে এক-তৃতীয়াংশ এমন মানুষকে দিও যিনি এর সবচেয়ে বেশি হকদার। তাই টাকাগুলো আমি একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছি যাতে এর হকদারকে দিতে পারি। আল্লাহর কসম, খুরাসান ত্যাগ করার পর এখন পর্যন্ত আপনার চেয়ে এর বড় হকদার আমি আর দেখিনি। তাই দিনারগুলো আপনি নিন। আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন এবং দারিদ্রতার মাঝেও আপনি যে বিশ্বস্ততা ও ধৈর্য দেখিয়েছেন তার যথাযথ পুরস্কার দিন।

তারপর খুরাসানী লোকটি চলে গেলো।

অশ্রুসিক্ত চোখে বৃদ্ধ লোকটি আল্লাহর দরবারে দুআ করলো, হে আল্লাহ, এই অর্থের মালিকের কবরে রহমত বর্ষণ করুন এবং তার সন্তানকে কল্যাণ দান করুন।

খুরাসানী লোকটি চলে যাবার পর আমিও চলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আবু গাইস নামের বৃদ্ধ লোকটি আমাকে অনুসরণ করে তার বাড়িতে ফিরিয়ে আনলো। তিনি আমাকে বসতে বলে বললেন, আমি লক্ষ্য করেছি প্রথম দিন থেকেই আপনি আমাকে অনুসরণ করছেন। গতকাল এবং আজ আপনি আমাদের অবস্থা দেখতে এসেছেন। আমি শুনেছি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,


যদি ভিক্ষাবৃত্তি না করে কিংবা কারো কাছে হাত না পেতেই আল্লাহর ভাণ্ডার থেকে তোমাদের অন্ন-সংস্থান হয়ে থাকে, তবে তা ত্যাগ না করে গ্রহণ করো।


তাই এটা সবার জন্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার।

বৃদ্ধ লোকটি তার মেয়ে, বোন, স্ত্রী ও শাশুরীকে ডেকে সবাইকে নিয়ে বসলো এবং আমাকেও বসতে বললো। আমরা মোট ১০ জন হলাম।  তিনি ব্যাগটি খুললেন এবং বললেন, তোমরা তোমাদের জামাকে কোলের উপর মেলে ধরো।

আমি তা-ই করলাম। কিন্তু মেলে ধরার মতো মেয়েগুলোর কাছে যথেষ্ট কাপড় ছিলো না, তাই তারা হাত পেতে দিলোবৃদ্ধ লোকটি সবাইকে এক দিনার করে দিতে থাকলো এবং আমার কাছে এসে বললো, এই নাও এক দিনার। ব্যাগটি খালি না হওয়া পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকলো এবং আমি একশত দিনার পেলাম।

আমি একশত দিনার পাওয়ায় যতোটা না খুশি হয়েছি, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছি তাদের অন্ন-সংস্থান হওয়ায়।

আমি যখন চলে যাচ্ছিলাম বৃদ্ধ লোকটি বললো, হে যুবক, তুমি আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত। এই অর্থগুলো তোমার সাথে রাখো, এগুলো হালাল। আর জেনে রাখো, আমি ভেজা জামা নিয়ে ফজরের সালাত আদায়ের জন্য উঠতাম। আমার আদায় হয়ে গেলে জামাটি খুলে আমার মেয়েদের দিতাম যাতে তারা একজন একজন করে সালাত আদায় করতে পারে। যুহর এবং আসর সালাতের মাঝে আমি কাজ করতে বের হতাম এবং আল্লাহ আমার রিযিকে যে খেজুর ও শুকনো রুটির টুকরো রাখতো তাই নিয়ে ফিরে আসতাম। বাড়ি ফিরে আমি আমার জামা খুলে মেয়েদের দিতাম এবং তার যুহর ও আসরের সালাত আদায় করে নিতো। মাগরীব ও ঈশার সময়ও একই ঘটনা ঘটতো। আমরা কখনোই এতো অর্থ দেখার আশা করিনি। আল্লাহর কাছে দুআ করি তিনি যেনো আমাদের অর্থগুলো সঠিকভাবে ব্যয় করার তৌফিক দান করেন এবং অর্থের মালিকের কবরে রহমত বর্ষণ করে তার পুরস্কারকে বহুগুণ করে দেন।

অবশেষে আমি তার দেয়া একশত দিনার নিয়ে বিদায় নিলাম এবং সেগুলোকে পরবর্তী দুবছর পর্যন্ত জ্ঞানের কথা লেখার কাজে ব্যয় করলাম। আমি সাধারণত কাগজ কেনা ও ভাড়ার কাজে অর্থগুলো ব্যয় করতাম। ১৬ বছর পর মক্কায় ফিরে গিয়ে লোকটির খোঁজ করে জানতে পারলাম আমাদের মধ্যে যে ঘটনা ঘটেছিলো তার দুমাস পরেই লোকটি মারা গিয়েছে। তার স্ত্রী, শাশুরী এবং দুবোনও মারা গিয়েছে। এখন শুধু বেঁচে আছে তার মেয়েরা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম রাজা ও রাজপুত্রদের সাথে তাদের বিয়ে হয়েছে। আমি তাদের বাড়িতে গেলাম এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা আমাকে অতিথির মতো সম্মান ও আদর-আপ্যায়ন করলো। দুআ করি আল্লাহ যেনো তাদের কবরে রহমত বর্ষণ করেন


আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিস্কৃতির পথ করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট।
[সূরা আত-তালাকঃ ২-৩]


মূল লেখকঃ মাহমুদ আব্‌দ আর-রায্‌যাক

উৎসঃ www.OnIslam.net

0 on: "কঠিন পরীক্ষা"