শুক্রবার, ২৭ জুন, ২০১৪

রহমতের মাসের জন্য প্রস্তুতি



আমাদের অনেকেই রামাদানের প্রস্তুতির জন্য ছটফট করতে থাকি, কিন্তু কীভাবে শুরু করবো এ ব্যাপারে অনেকেরই কোন ধারণা নেই। নিচে কিছু কৌশল সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো যেগুলো ইনশা আল্লাহ আমাদের মন ও হৃদয়কে আসন্ন রহমতের মাসের জন্য তৈরি হতে সাহায্য করবে।

নিয়্যাত করুনঃ এটি খুব সহজ কাজ, কিন্তু এর প্রভাব খুব শক্তিশালী। হয়তো আপনি রামাদানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে চান, কিন্তু বুঝে উঠতে পারছেন না কীভাবে স্কুল, ক্লাস, পরিবার ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজের সাথে রামাদানের প্রস্তুতি গ্রহণের সময়কে খাপ খাওয়ানো যায়। রামাদানের প্রস্তুতি গ্রহণের সময়কে আলাদা করার পরিবর্তে আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মকেই রামাদানের প্রস্তুতি গ্রহণের উপায় হিসেবে কাজে লাগান।

রামাদান কারীমউদাহরণস্বরূপ, হয়তো আপনার মা আপনাকে বললেন ছোটভাই/বোনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে,  যদিও অনেকদিন পর কিছুটা সময় পাওয়ায় আপনি ঠিক করেছিলেন কয়েক পাতা কুরআন তিলাওয়াত করবেন। রামাদানের প্রস্তুতি গ্রহণের একটি সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে বলে মন খারাপ না করে এমনভাবে নিয়্যাত করুন যে, আপনি আপনার ছোটভাই/বোনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসছেন আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা)-কে সন্তুষ্ট করার জন্য; আর রামাদানের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন মায়ের আদেশ পালন করে, পরিবারের সদস্যদের সাহায্য করে, আত্মীয়তার সম্পর্ক দৃঢ় করে...(আর এ তালিকা ক্রমবর্ধমান)।


এখানে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, রমাদানের প্রস্তুতি গ্রহণ কোন জাঁকজমকপূর্ণ, সাঙ্ঘাতিক কিংবা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয় যার জন্য দিনের বিশেষ সময়ের প্রয়োজন হয়। আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মের অনেক কিছুই রামাদানের প্রস্তুতি গ্রহণের অংশে পরিণত হতে পারে যদি আপনার নিয়্যাত বিশুদ্ধ থাকে।

অল্প পরিশ্রমে অধিক ফল লাভের জন্য এই কাজগুলো করুনঃ

১. আল্লাহর কাছে আপনার ভাই-বোনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। উবাদা বিন সামেত (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিততিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কথা বলতে শুনেছি,

যে ব্যক্তি মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, তাকে প্রত্যেক মুমিন পুরুষ ও নারীর বিনিময়ে একটি করে পূণ্য লিখে দেয়া হবে
[ত্বাবরানী, শাইখ আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছে]


২. আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

যে ব্যক্তি প্রত্যহ সকাল ও সন্ধায় ১০০ বার সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী পাঠ করে তার পাপরাশি সমুদ্রের ফেনারাশির ন্যায় অপরিসীম হলেও তা ক্ষমা করা হয়।
[বুখারী, মুসলিম]

৩. যদি কোন ব্যক্তি ১০০ বার সুবহান আল্লাহ পাঠ করে, তবে তার জন্য এক হাজার নেকী লেখা হয় এবং তার আমলনামা থেকে এক হাজার পাপ মুছে যায়।
                          [মুসলিমঃ ২৬৯৮]

৪. বাজারে যাওয়ার সময় আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা)-কে স্মরণ করুন। যে ব্যক্তি বাজারে গিয়ে এ দুআ পাঠ করেঃ

লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদা্হু লা-শারীকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ইউহ্‌য়ী ওয়া ইউমীতু ওয়া হুয়া হাইয়্যুন্‌ লা ইয়ামুতু বি ইয়াদিহিল খাইর ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শা্য়্যিন ক্বাদীর।

আল্লাহ্ তার জন্য এক লক্ষ নেকী লিখে দেন ও এক লক্ষ গুনাহ্ ক্ষমা করে দেন, আর তার জন্য বেহেশতে একটি গৃহ নির্মান করে রাখা হয়।
 [আত-তিরমিযী, আল-আলবানী একে হাসান বলেছেন]

আপনার ইবাদাত বাড়িয়ে দিনঃ আপনার হৃদয়কে রহমতের মাসের জন্য প্রস্তুত করতে রামাদান শুরুর আগেই ইবাদাত বাড়িয়ে দিন। অল্প কিন্তু নিয়মিত ইবাদাতই যথেষ্ট। আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বর্ণনা করেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, আল্লাহ তাআলার কাছে সবচাইতে প্রিয় আমল কী? তিনি বললেনঃ যে আমল নিয়মিত করা হয়। যদিও তা অল্প হোকতিনি আরও বললেনঃ তোমরা সাধ্যমত আমল করে যাও।
[সহীহ বুখারীঃ ৬০২১]

উদাহরণস্বরূপ, আজ থেকে রামাদান শুরুর পূর্ব পর্যন্ত এমনকি রামাদানের মধ্যেও আমি ইশার সালাতের পর দুরাকাআত সুন্নাহ সালাত আদায় করবো। এখনই নিয়্যাত করুন এবং আজ থেকেই শুরু করুন। প্রতিবার দুরাকাআত সালাত আদায়ের পর আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, আমি এমনটা করছি রামাদানের প্রস্তুতি হিসেবে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য।

আজই দুআর তালিকা তৈরি করুনঃ এ মাস হচ্ছে ইহকাল ও পরকালের সাথে সম্পর্কিত সবকিছু আল্লাহর কাছে চাওয়ার মাস। রামাদানের শেষ ১০ দিনের বিশেষ দুআর জন্য বসে থাকবেন না। কেননা, ঈদের পরপরই দেখা যায় আমাদের আরো যে পঞ্চাশটি জিনিসের প্রয়োজন সে সম্পর্কে দুআ করতে একেবারেই ভুলে গেছি। এখন থেকেই তালিকা করতে থাকুন, যা কিছু মনে আসে তা-ই লিখে ফেলুন। ইনশা আল্লাহ  এ মাসে নিয়মিত দুআর সময় এটি আমাদের চাহিদাগুলোর কথা মনে করিয়ে দিবে এবং আমাদের হৃদয়কে আল্লাহর প্রতি রুজু হতে সাহায্য করবে, যিনি আমাদের দুআ কবুল করে থাকেন।

রামাদানের লক্ষ্যসমূহ লিখে রাখুনঃ সকল ফরজ সালাত আদায় করা? সকল সুন্নাহ সালাত আদায় করা? সমগ্র কুরআন তিলাওয়াত করা? প্রতিদিন দান করা? মসজিদে ইতিকাফ করা? একটি বড় পাপ ত্যাগ করা, যা আপনি অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছেন? মন থেকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা? এক জায়গায় সব লিখে ফেলুন, এমন একটি স্থানে টানিয়ে রাখুন যেটি নিয়মিত আপনার চোখে পড়ে, আর এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করতে থাকুন।

পরিকল্পনা করুনঃ আপনার লক্ষ্যগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করুন এবং পরিকল্পনা করার চেষ্টা করুন কীভাবে সেগুলো বাস্তবে রূপদান করা যায়। যেমনঃ আপনি হয়তো নিয়মিত সুন্নাহ সালাত আদায়ের অনেক চেষ্টা করছেন। রহমতের এ মাসে সুন্নাহ সালাত আদায়ের পুরস্কারের (আজ্‌র) গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করুন। মনে করুন এই সুন্নাহ সালাতগুলো কিয়ামতের দিন আপনার নেকের পাল্লাকে ভারী করবে। তাই রামাদান জুড়ে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সকল সুন্নাহ অনুসরণ করার চেষ্টা করুন। ব্যস্ততার কারণে ফরযের পরপরই যদি সুন্নাহ সালাত আদায় করতে না পারেন, তবে যখনই সুযোগ পান তখনই আদায় করুন।

আপনার পরিকল্পনা অনেকটা এমন হতে পারেঃ

লক্ষ্যঃ সকল ফরয সালাত আদায়ের পর সুন্নাহ সালাত আদায় করা।
পদ্ধতিঃ কিয়ামতের দিন নেকের পাল্লায় নিয়মিত সুন্নাহ সালাত আদায়ের ফলে প্রাপ্ত পুরস্কারের কথা কল্পনা করা। ফরয সালাতের পরপরই সুন্নাহ সালাত আদায় করা। যদি কোন কারণে আদায় করতে না পারি তবে যখনই সুযোগ পাবো তখনই আদায় করে নিবো। কোনভাবেই সুন্নাহ সালাত ত্যাগ করবো না।

আরেকটি দৃষ্টান্ত হতে পারে রামাদানের মধ্যে সমগ্র কুরআন তিলাওয়াত সম্পন্ন করা।

লক্ষ্যঃ এ মাসে সমগ্র কুরআন তিলাওয়াত করা।
পদ্ধতিঃ প্রত্যেক সালাতের পর ৪ পাতা কুরআন তিলাওয়াত করা। ৫ ওয়াক্ত সালাত x ৪ পাতা = ২০ পাতা। ২০ পাতা = প্রায় ১ পারা। ১ পারা x ৩০ দিন = সম্পূর্ণ কুরআন।

আমাদের সাথে থাকা অনেক মুসলিমই গত মাসে মারা গিয়েছেন, যারা এ বছরের রামাদান পাননি। গত বছরের রামাদনই ছিল তাদের জীবনের সর্বশেষ রামাদান। আপনি কি এবারের রামাদানকে কাজে লাগাতে প্রস্তুত? এটা কি আপনার জীবনের শেষ রামাদান হতে পারে না?

এবারের রামাদানকেই সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর লক্ষ্যস্থির করুন। সামান্য প্রচেষ্টা, যেমনঃ ছোট ছোট নিয়্যাত ও কিছু বাড়তি ইবাদাতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করবো যেন তিনি আমাদের হৃদয়কে নরম করে দেন, আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে রামাদানের সফল ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন এবং তাঁর প্রতি প্রত্যাবর্তনকে সহজ করে দিয়ে তার উপর অবিচল থাকার তৌফিক দেন। আমীন।

মূল লেখকঃ মারিয়াম আমির-ইবরাহিমী

উৎসঃ www. suhaibwebb.com

0 on: "রহমতের মাসের জন্য প্রস্তুতি"